মক্কার লোকেরা মালামাল বোঝাই কাফেলাকে স্বাগত জানানোর জন্য দৌড়ে আসার প্রতিযোগিতা করত; যার জন্য তারা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছিল। এ সকল কাফেলা তেল, ময়দা, খাবার, বিলাসবহুল পোশাক, কাপড়-চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসত।
যখন সূর্য সূর্যাস্তের কাছাকাছি; তার লাল রশ্মি মরুভূমির দিগন্তের বালির সাথে মিশে যাওয়ার উপক্রম; আকাশ গোধূলির গাঢ় লালে রঙিন হয়ে আছে। কাল্পনিক ছায়া মূর্তি ধীরে ধীরে দূর দিগন্ত স্পষ্ট হতে লাগল।
কাফেলার আগত লোকেরা কাবার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মূর্তিগুলিকে প্রদক্ষিণ করতে এবং শাম থেকে থেকে তাদের দেবতাদের জন্য যে উপহারগুলো নিয়ে এসেছিল, তা তাদের কাছে পেশ করতে দ্রুত কাবার দিকে ছুটে গেল।
কষ্টের সফরে আবু তালেব ক্লান্তি ও অবসাদে ভোগা সত্ত্বেও তিনিও ইবাদতের উদ্দেশ্যে কাফেলার বাকি লোকদের সাথে দৌড়ান; যা তারা সফর শেষে করত।
নবীজি সা. কুরাইশদের দেবতাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিতে এবং তাদের সামনে উপহার পেশ করতে অস্বীকৃতি জানাতেন, এতে আবু তালেব বিস্মিত হতেন না।
লোকেরা সর্বদা তাঁকে সেগুলোর কাছে যাওয়া এবং সেগুলোর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য অনুরোধ করত। কিন্তু তিনি সর্বদা সেগুলো থেকে দূরে সরে থাকতেন এবং সেই মূর্তিগুলোর উপহাস করেছেন এবং তাদের অজ্ঞতা নিয়ে ঠাট্টা করেছেন যারা তাদের নিজের হাতে তৈরি করে, তারপর আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পূজা করে।
মক্কায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও হিলফুল ফুজুল গঠনে নবীজি:
নবীজি সা. তখন ২০ বছর বয়সে উপনীত হন। হঠাৎ একদিন মক্কার নিরবতা এবং শান্তি; ভয়ংকর ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রূপ নিল। সেই সময়ে মক্কার বিপুল সংখ্যক লোককে এর বলির শিকার হতে হয়েছিল।
কতিপয় গোত্রে যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এবং প্রায় সমস্ত আরব উপজাতিকে গ্রাস করে নিল।
কুরাইশগণ যুদ্ধরত দলগুলোর মধ্যে পুনর্মিলন এবং ঝগড়া-বিবাদ মিমাংসা করার জন্য আরবদের মধ্যে একটি নতুন জোটের আহ্বান জানিয়েছিল এবং সেই জোটের নাম ছিল: ‘হিলফুল ফুযুল’।
মক্কার নেতৃবৃন্দ এবং যুদ্ধরত গোত্রের প্রধানগণ আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআন নামক এক ব্যক্তির বাড়িতে সমবেত হল।
আরব গোত্রগুলোর মধ্য থেকে উপস্থিত লোকেরা প্রতিজ্ঞা করল যে, তারা মক্কার অধিবাসী এবং অন্যদেরকে নির্যাতিত হতে দিবে না। কেউ নির্যাতিত হলে তাকে সাহায্য করবে এবং তার থেকে জুলুম প্রতিহত করবে এবং জালেম থেকে তার হক এনে দিবে।
যে সেতুবন্ধন কুরাইন নেতৃবর্গ এই নতুন সংঘের মাধ্যমে তৈরি করে দিয়েছেন তাতে মক্কাবাসী আনন্দিত হল।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাতে তাঁর চাচাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি বাকি জীবন এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন।
কেননা এটা ছিল পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতা, নিরাপত্তা ও শান্তির বহিঃপ্রকাশ।
মক্কা ছিল ইয়েমেন থেকে আগত বা শামে রওয়ানা হওয়া আরব বাণিজ্যিক কাফেলার প্রাণ কেন্দ্র। যেমনটিভাবে গোত্রগুলোর অপেক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কারণ মক্কায় কাবার উপস্থিতির কারণে এটি ধর্মীয় বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করত এবং বিখ্যাত, বড় বড় বাজারের কারণে প্রতিনিধিত্ব করেছিল;
যেখানে ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য সরবরাহ করার জন্য প্রতিযোগিতা করত এবং কবি ও সাহিত্যিকগণ তাদের উত্তম কবিতা ও প্রতিভা প্রদর্শন করার প্রতিযোগিতা করতেন।
গান-বাজনার আসর, যার প্রতি মক্কার জনগণের আগ্রহ ছিল দুর্দান্ত, যেখানে যুবক-বৃদ্ধ সকলেই উপস্থিত হতে আগ্রহী; তবে নবীজি সা. তাঁর সমবয়সি এবং সঙ্গীদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন। তিনি তাঁর তাঁর সমবয়সি এবং সঙ্গীদের সাথে এ বিষয়ে বিরোধিতা করতেন। গান-বাজনার প্রতি অন্যান্য যুবকেরা আকৃষ্ট হলেও তিনি হতেন না।
নবীজি সা. অধিক উত্তম গুণাবলি এবং নম্র স্বভাবের কারণে মানুষের মাঝে ‘আস সদিকুল আমীন’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নবীজির সিরিয়া সফর:
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রাসুল সা. দুই বার সিরিয়া সফর করেন। প্রথমবার চাচা আবু তালেবের সাথে দ্বিতীয়বার হযরত খাদিজা রা.-এর ব্যবসায়িক মাল নিয়ে সিরিয়ায় সফর করেন। নবীজি সা. তাঁর চাচা আবু তালিবকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি তাঁর পশুগুলো চড়াতেন। এটি এমন এক পেশা, যার উপর মক্কার অনেক লোক তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্ভর করত।
যখন তিনি পঁচিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন তাঁর চাচা তাকে ব্যবসার নিয়োজিত হওয়ার প্রস্তাব দেন। চাচা আবু তালেব মক্কার সবচেয়ে সম্মানিতা, সম্পদশালী মহিলা খাদিজা রা.-এর অর্থ সম্পদ ব্যবসায়িক কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করেন।
হযরত রাসুল সা. খাদিজা রা.-এর একটি বিশাল বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে পুনরায় শামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। সফরে খাদিজা রা.-এর ক্রীতদাস “মায়সারা” তাঁর সঙ্গী হল। নবীজি সা. এর উত্তম আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা ও বিনয়িতা দেখে তাঁর প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়।
মায়সারা তার মনিবা খাদিজাকে রাসুল সা.-এর নৈতিকতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে যা শুনেছেন এবং দেখেছেন, সে সম্পর্কে বলতে সংবাদ দেন এবং মায়সারার কথা খাদিজার আত্মার উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। ফলে মুহাম্মদ সা.-এর মর্যাদা তার মধ্যে বেড়ে যায়।
খাদিজা রা.-এর সাথে নবীজির বিবাহ:
যেহেতু খাদিজা রা. বিধবা ছিলেন। বয়স ছিল ৪০ বছর। ইতিপূর্বে তার স্বামী ইন্তেকাল করেছে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য সৎ এবং বিশ্বস্ত একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল। তিনি রাসুল সা.-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করলেন। এমনকি একপর্যায়ে তিনি রাসুল সা.-এর নিকট তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি আগ্রহ জানার জন্য প্রস্তাব পাঠান।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে তাঁর চাচার সাথে পরামর্শ করে প্রস্তাবে রাজি হন। রাসুল সা. তাঁর চাচা এবং বংশীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে খাদিজা রা.-এর গৃহে উপস্থিত হন এবং সেখানে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিবাহের খুতবা চাচা আবু তালেব পাঠ করেন এবং তাতে নবীজি সা.-এর উত্তম গুণাবলিগুলো তুলে ধরেন।
মহানবী সা.-এর সঙ্গে খাদিজা রা.-এর দাম্পত্যকাল ছিল ২৪ বছর। নারীদের মধ্যে সবার আগে তিনি ঈমান গ্রহণ করেন। খাজা আবু তালেবের মৃত্যুর কয়েক দিন পর তিনিও দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।