হযরত মুহাম্মদ সা.-এর দাওয়াতি কার্যক্রম বন্ধের জন্য কাফেররা বিভিন্নভাবে তাকে কষ্ট দিতে লাগল, তাতে তারা ব্যর্থ হয়ে রাসুল সা.-এর বংশ বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিবের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয় যে, তাদের সাথে কেউ কোন প্রকার লেনদেন করবে না; তাদের সাথে কাউকে বিয়ে দিবে না এবং তাদের কাউকে কেউ বিয়ে করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নবীজি সা. কে তাদের হাতে হত্যার জন্য অর্পণ করে। এ বিষয়ে একটি চুক্তি নাম লিখে কাবার দেয়ালে টানিয়ে দেয়।
বনু হাশম ও বনু আব্দুল মুত্তালিব শিয়াবে আবু তালেবের ভিতরে প্রায় তিন বছর বন্দী ছিলেন। তারা সেখানে বিভিন্ন প্রকার দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণায় তারা গাছের পাতা এবং জানোয়ারের চামড়া খেয়ে উদর পূর্ণ করতে হয়েছে। যখন কুরাইশের সম্ভ্রান্ত লোকেরা তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর নেমে আসা দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি কবেরন। তাদের উপর দয়ার্দ্র হলেন এবং তারা বয়কট উঠিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হলেন।
বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালিব এই বয়কট থেকে মুক্তি লাভ করল। হযরত মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর সাথীরা তাদের গৃহে নিরাপদে ফিরে যায়। কুরাইশদের বয়কট সমাপ্ত হওয়ার পর নবীজি সা.-এর উপর লাগাতার বিপদ আপদ আসতে লাগলো। এদিকে তাঁর চাচা আবু তালেব প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বৃদ্ধ ছিলেন, যার বয়স ৮০ অতিক্রম করেছে।
আবু তালেবের মৃত্যু:
রাসুল সা.-এর আগ্রহ ছিল যে, মৃত্যুর পূর্বে তাঁর চাচা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর ভাগ্যে হেদায়েত লিখে রাখেন নি। ফলে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের ধর্মের উপর মৃত্যুবরণ করেন। রাসুল সা.. তাঁর মৃত্যুতে মর্মাহত হন। কেননা তিনি তাঁর প্রিয় মানুষ ছিলেন, যে তাকে শক্তি যোগাত, বিপদাপদে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতো। তাঁর মৃত্যুর কিছু দিন পর উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজা রা. ইন্তেকাল করেন।
চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর কুরাইশরা হযরত মুহাম্মদ সা. কে মারাত্মকভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। ফলে হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর গোলাম জায়েদ বিন হারেছাকে সাথে নিয়ে তায়েফের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
হয়তোবা তিনি সেখানে এমন কাউকে পাবেন, যে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা কেউই রাসুল সা.-এর দাওয়াত দিয়ে সাড়া দিল না বরং সকলেই তাকে নিয়ে উপহাস করল এবং কষ্ট দিল। তাদের ছোট ছোট বাচ্চা এবং নির্বোধদেরকে তাঁর উপর লেলিয়ে দিল। যেন তারা তাকে গালিগালাজ করতে পারে। তারা তাঁর উপর পাথর নিক্ষেপ করতে লাগল এমনকি রাসুল সা.-এর বরকতময় দুটো পা থেকে রক্ত ঝড়তে লাগলো।
তিনি ব্যথায় জর্জরিত ও দুঃখ কষ্ট নিয়ে স্বল্প বিশ্রাম শেষে মক্কার পথ ধরলেন। আল্লাহ তাআলা রাসুল সা.-এর নিকট জিব্রাইল আলাই সাল্লামকে এবং পাহাড়ের কাজে নিয়োজিত ফেরেশতাদের সহ প্রেরণ করলেন এই অবাধ্যদের ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য।
ফেরেশতাগণ এসে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর নিকট এসে আবেদন করলেন, আপনি আমাদেরকে আদেশ দিন, আমরা এই অবাধ্যদেরকে পাহাড় চাপা দিয়ে ধ্বংস করে দিব। নবীজি সা. তাদেরকে বলেন: বরং আমি আশাবাদী যে, আল্লাহ তায়ালা বংশধরদের মধ্য থেকে এমন প্রজন্ম তৈরি করবেন, যারা এক আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না।
রাসুল সা. মক্কার নিকটবর্তী হলে তিনি তাঁর কতিপয় সাথীদের নিকট তাদের নিরাপত্তায় মক্কায় প্রবেশের আবেদন জানান। তারা সকলেই ঘৃণা ভরা মনে তা প্রত্যাখ্যান করে। তবে মাতআন ইবনে আদী ব্যতীত, যিনি তাঁর পরিবার এবং গোত্রের অন্যান্য লোকদের নিয়ে তরবারিসহ বেরিয়ে পড়েন রাসুল সা.-এর নিরাপত্তার ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়ার জন্য।
অতঃপর রাসুল সা. তাঁর নিরাপত্তায় প্রবেশ করেন এবং বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেন নিরাপদে তাঁর গৃহে ফিরে যান।
হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মেরাজের ঘটনা
আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সা. কে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন এবং তাঁর অন্তর থেকে দুঃখ কষ্ট দূর করতে চাইলেন। যে কষ্টের তিনি মুখোমুখি হন তায়েফের নির্বোধদের থেকে এবং একত্ববাদের দিকে তাঁর দাওয়াত অস্বীকারকারীদের থেকে । ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্মানিত করেন। তাকে এক রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা নিয়ে যান।
সেখান থেকে ঊর্ধ্ব আকাশে গমন করেন। এই সফরে তিনি অনেক বড় বড় নিদর্শন দেখতে পান। যেমন: জান্নাতে প্রবেশ, জাহান্নাম সম্পর্কে অবগতি এবং আল্লাহ তায়ালার সাথে কথোপকথন, নবীদের সাথে সাক্ষাৎ। এ রাতেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। বরকতময় সফর শেষে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে রাতেই মক্কায় ফিরে আসেন। সকাল বেলায় যখন তিনি সে ব্যাপারে কুরাইশদেরকে সংবাদ দেন। তারা তাকে নিয়ে উপহাস করতে লাগলো এবং মসজিদুল আকসার বিবরণ জিজ্ঞাসা করতে লাগলো।
আল্লাহ তাআলা জিব্রাইল আ.-এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মসজিদুল আকসা তুলে ধরেন। তিনি তা দেখে দেখে মসজিদুল আকসার সম্পূর্ণ বিবরণ প্রদান করেন। যেমনিভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদের নিকট আগত কাফেলার ব্যাপারে সংবাদ প্রদান করেন, যার অপেক্ষা তারা দীর্ঘদিন যাবত করছিল এবং আগত কাফেলা পৌঁছার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন।
অতঃপর কাফেলাটি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্ধারিত সময়সীমা ভিতর মক্কায় এসে পৌঁছায়। এ সকল নিদর্শন এবং মুজিজা দেখা সত্ত্বেও তারা তাদের মিথ্যা এবং অবাধ্যতার উপর অটল রইল। তারা আবু বকর রা. নিকট গিয়ে নবীজি সা.-এর ব্যাপারে সংবাদ দিল। আবু বকর রা. তাদেরকে বলেন: আল্লাহর শপথ! যদি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এমনটি বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্যই বলেছেন। সেদিন থেকে আবু বকর রা. কে ‘সিদ্দিক’ উপাধীতে ভূষিত করা হয়।