হযরত মুহাম্মদ সা. তিন বছর গোপনে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তাঁর দাওয়াতে মুমিনদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। একদিন জিব্রাইল আ. হযরত মুহাম্মদ সা. -এর নিকট আগমন করেন; তাঁর রবের পক্ষ থেকে একটি মহান আদেশ নিয়ে, যাতে তিনি তাঁকে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের দিকে আহ্বান করতে আদেশ দেন। আল্লাহর আদেশ পালন করার জন্য রাসুল সা. কাবার পার্শ্ববর্তী সাফা পাহাড়ে আরোহণ করলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে মক্কাবাসীদের ডাকতে লাগলেন।
লোকেরা যখন জড়ো হল, তিনি তাদেরকে বললেন: আমি যদি তোমাদেরকে বলি যে, পাহাড়ের পেছনে শত্রু বাহিনী আছে। তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? তারা এক বাক্যে বলল: আমরা আপনাকে কখনো মিথ্যাবাদী পাইনি। তিনি তাদের সংবাদ দেন যে, তিনি তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত নবীজি এবং তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিতে আহ্বান করেন।
এ কথা শুনা মাত্রই আবু লাহাব গালি-গালাজ শুরু করে দিল এবং বলল: “তোমার সারা দিন ধ্বংস হোক! এ জন্যই কি তুমি আমাদেরকে সমবেত করেছো?”
আবু তালেবের কাছে কুরাইশদের প্রতিনিধি প্রেরণ
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহ্বান করতে থাকেন এবং মূর্তি পূজা ত্যাগ করার প্রতি আহ্বান করেন যেগুলো উপকার বা ক্ষতি করার যোগ্যতা রাখে না। ফলে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. -এর প্রতি বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
কুরাইশরা তাঁর উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তারা তাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি প্রতিনিধি দলকে হযরত মুহাম্মদ সা. এর চাচা আবু তালিবের কাছে পাঠাল। যেন তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে তার দাওয়াতি কাজ থেকে বাঁধা প্রদান করেন।
তারা আবু তালেবের নিকট গিয়ে আবেদন করল যে, তিনি যেন তার ভাতিজাকে তাদের প্রভুদেরকে কটূক্তি করা হতে বিরত রাখেন। অন্যথায় তিনি তাদের রূঢ়তার সম্মুখীন হবেন।
আবু তালেব নবীজিকে ডেকে পাঠালেন এবং তাদের আনিত অভিযোগের ব্যাপারে তিনি তাকে বললেন। নবীজি সা. ধারণা করলেন যে, তাঁর চাচা তাঁর থেকে পৃথক হয়ে যাবেন। তিনি তাঁর চাচাকে বললেন: “হে চাচা! আল্লাহর শপথ! যদি তারা আমার ডান হাতে চাঁদ এবং বাম হাতে সূর্যেরও রেখে দেয়। তবুও আমি দ্বীন ছাড়বো না। হয়ত আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীন বিজয়ী করবেন অন্যথায় আমি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবো। তবুও দিন ছাড়বো না।”
অতঃপর নবীজি সা. কাঁদতে লাগলেন এবং চিন্তা ও পেরেশানি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আবু তালেব বুঝতে পারলেন যে, তিনি তার ভাতিজাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন।
তিনি তাকে বললেন: ভাতিজা! তোমার যা ভাল মনে হয়, তা কর। আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে এমন কোন বিষয় বাধ্য করব না, যা তুমি অপছন্দ কর। রাসুল সা. আল্লাহর দ্বীনে লোকদেরকে আহ্বানে অবিচল রইলেন।
হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মক্কা জীবন:
কুরাইশদের সীমাহীন অত্যাচারের মুখোমুখি সাহাবায়ে কেরাম হন। তাদের কেউই এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পান নি। হযরত মুহাম্মদ সা. ও তাঁর দাওয়াতি কাজে বিরোধীতার উপর কুরাইশরা ঐক্যবদ্ধ হলো। তারা তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে লাগল। তাঁর ব্যাপারে এ কথা বলে বেড়াতো যে, তিনি পাগল, তিনি একজন জাদুকর, মিথ্যুক এবং গণক যে অদৃশ্য সংবাদ জানার ব্যাপারে দাবি করে। (নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক।)
নবীজি সা.-এর চাচা আবু লাহাব লোকদেরকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ এবং তাঁর কথা শ্রবণ করার ব্যাপারে সতর্ক করত। কিন্তু এ সকল বাধা-বিপত্তি রাসুল সা. কে তাঁর দাওয়াতি কাজে দুর্বল করেনি। এক পর্যায়ে কুরাইশরা নবীজি সা. কে প্রচণ্ডভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। তারা তাঁর পথে কাঁটা বিছিয়ে দিত এবং তিনি নামাজরত অবস্থায় তাঁর উপর ময়লা নিক্ষেপ করত এবং তাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতো।
নবীজি সা.-এর উপর ঈমান আনা কেউই এই দুঃখ-কষ্ট থেকে নিরাপদ ছিল না। প্রত্যেক গোত্রই তাদের মাঝে ঈমান আনা ব্যক্তিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং তাদের সাথে রূঢ়তা পূর্ণ আচরণ করতো। তাদেরকে আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দিত। চাবুক দ্বারা প্রহার করত যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের দ্বীন থেকে ফিরে আসত।
হযরত বেলাল রা.-এর আত্নত্যাগ
উমাইয়া বিন খলফ তার গোলাম হযরত বেলাল রা. কে প্রচণ্ড রোদে উক্ত বালিতে পাথর খণ্ড চাপা দিয়ে রাখত এবং এভাবেই তাকে দীর্ঘ সময় যাবত রেখে দিত। হযরত বেলাল রা. এ সকল দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতেন এবং তিনি বলতেন: আহাদ, আহাদ অর্থাৎ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।
হযরত বেলাল রা.-এর দুঃখ কষ্ট দেখে এক পর্যায়ে হযরত আবু বকর রা. তাকে ক্রয় করে আজাদ করে দেন।
ইসলামের প্রথম শহীদ-শহীদ:
যখন মক্কার কাফেররা হযরত ইয়াসির ও তাঁর পিতামাতার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে জানতে পারল, তখন তাদের জীবনে নতুন একটি কষ্টের অধ্যায়ের সূচনা হলো।
তারা তাদেরকে মরুভূমিতে প্রচণ্ড রোদে ফেলে রাখত যার ফলে তাদের চামড়া ঝলসে গিয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ সা. যখন এ সকল দুঃখ-কষ্ট দেখতে পেলেন তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন: হে ইয়াসির পরিবার! নিশ্চয়ই তোমাদের ঠিকানা জান্নাত।
হযরত ইয়াসির দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শহীদ হয়ে যান। তিনিই ইসলামের প্রথম শহীদ। আবু জাহেল হযরত সুমাইয়া রা. কে বর্শা বিদ্ধ করে। ফলে তিনিও মারা যান। তিনিই ইসলামের প্রথম শহীদা।
সাহাবায়ে কেরামের হাবশায় হিজরত:
হযরত মুহাম্মদ সা. এর মক্কা জীবনে মুসলমানদের উপর দুঃখ-কষ্ট দিন দিন বাড়তে লাগলো। হযরত মুহাম্মদ সা. সাহাবাদেরকে হাবশায় হিজরত করার পরামর্শ দেন। তিনি তাদেরকে বলেন: ‘তোমরা হাবশায় গমন কর। সেখানে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক রয়েছে, যার নিকট কেউ জুলুমের শিকার হয় না।”
হাবশায় প্রথম হিজরত:
প্রথমে হাবশায় ১২ জন পুরুষ এবং ১৪ জন নারী হিজরত করেন। যাদের অগ্রে ছিলেন হযরত ওসমান বিন আফফান রা. এবং তাঁর স্ত্রী, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা রোকাইয়া রা.। এটি ছিল হাবশার উদ্দেশ্যে প্রথম হিজরত, যা নবুওয়াতের পঞ্চম বছর হয়েছিল।
যখন মুসলমানগণ হাবশায় পৌঁছান, হাবশার বাদশাহ নাজাশী তাদের সাথে কোমল আচরণ করেন এবং তারা তাঁর আশ্রয়ে শান্তি ও নিরাপত্তায় বসবাস করতে লাগলেন।
হাবশায় দ্বিতীয় হিজরত:
কয়েক মাস পর মুসলমানদের অপর একটি দল হাবশায় হিজরত করে, যার সংখ্যা ছিল ৮৩ জন পুরুষ এবং ১৮ জন মহিলা। তারা সেখানে কল্যাণ, মঙ্গল এবং নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেন। ফলে নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করতে লাগলেন।
কুরাইশরা হাবশায় হিজরত করে যারা নিরাপদের বসবাস করছিল তাদের পিছু ছাড়লো না। কুরাইশরা তাদের মধ্য থেকে দুইজন মেধাবী ব্যক্তিকে হাবশার শাসকের নিকট বিরাট উপঢৌকন সহকারে পাঠায়। তারা হলেন: আমর ইবনুল আস এবং আব্দুল্লাহ বিন রবীয়া। যেন হাবশার শাসক মুসলমানদেরকে মক্কায় ফেরত পাঠায়।
কিন্তু বাদশাহ নাজাশী তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনেন। দ্বীনের ব্যাপারে জাফর বিন আবু তালেব রা. দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বাদশাহর সামনে এই দ্বীনের মর্যাদা এবং উদারতা স্পষ্ট করেন। অতঃপর সূরা মরিয়মের প্রথম আয়াত পাঠ করেন।
তা শুনে বাদশাহ নাজাশী ক্রন্দন করেন এবং তিনি আমর ইবনুল আস ও তার সাথীকে বলেন: তোমরা ফিরে যাও। আল্লাহর শপথ! আমি কখনোই তাদেরকে তোমাদের হাতে হস্তগত করব না। ফলে কুরাইশ প্রতিনিধি দল লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসল।
হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর প্রকাশ্য দাওয়াতের তিন বছর অতিক্রম করলেন। এ সময়ে নবীজি সা. এবং তাঁর সাথীদের উপর কুরাইশদের জুলুম-নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে ফেলে।
আবু জাহেলের মূর্খতা ও হামজা রা.-এর ইসলাম গ্রহণ
একদিন আবু জাহেল সাফা পাহাড়ের নিকট হযরত মুহাম্মদ সা.-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল। সে তাঁকে গালিগালাজ করতে লাগল এবং পাথর দিয়ে রাসুল সা.-এর মাথায় আঘাত করল। ফলে, হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মাথা থেকে রক্ত বেরোতে লাগল। এ সংবাদ যখন হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব রা.-এর কানে পৌঁছায়, তিনি প্রচণ্ড রাগান্বিত হন। এবং আবু জাহেলের উদ্দেশ্যে রওনা হোন।
গিয়ে দেখেন, আবু জাহেল তার এই হীন কাজের ব্যাপারে গর্ব করছে। তিনি তাকে বলেন: তুমি কি আমার ভাতিজাকে কষ্ট দিয়েছো। অথচ আমি তাঁর ধর্মে বিশ্বাসী? এ কথা বলে তাকে ধনুক দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে আবু জাহেলের মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হলো।
অতঃপর তিনি হযরত মুহাম্মদ সা.-এর নিকট গিয়ে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানগণ আনন্দিত হন।