১ম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের শুরুর দিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা., আবু বকর রা. এবং তাদের সাথে আমের বিন ফুহাইরা ও আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিত মদিনা অভিমুখে হিজরতের যাত্রা শুরু করেন। রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ রোজ সোমবার নবীজি সা. কুবায় পৌঁছেন। কুবা মদিনার উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি স্থানের নাম। মুসলমানগণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য দৌড়িয়ে আসেন। নবীজি সা.-এর আগমনে আনন্দিত হয়ে তারা তাকবীর দিতে লাগলেন।
ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণ
নবী সা. কুবায় ৪০ দিন অবস্থান করেন আর এরই মাঝে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই ছিল ইসলামের প্রথম মসজিদ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কুবাতে থাকাকালীন সময়ে আলী ইবনে আবু তালিব রা. প্রাপ্য ব্যক্তিদের আমানত বুঝিয়ে দিয়ে তার সাথে মিলিত হন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে মদিনাবাসীর পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা
মোবারক কাফেলা চলতে লাগলো এমনকি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ রোজ শুক্রবার মদিনায় গিয়ে পৌঁছল। স্বাগত জানানোর জন্য মদিনা বাসী সকলেই বেরিয়ে এলো এবং তাদের চেহারায় আনন্দের আতিশয্য স্ফুটিত হতে লাগল। যা তাদের অন্তরকে ভরে দিল। তারা উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতে লাগলো।
যার ফলে মদিনার প্রান্ত গুলো প্রকম্পিত হল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমন উপলক্ষ্যে স্বাগত জানাতে তারা এই নাশিদটি আবৃত্তি করল:
طلع البدر علينا // من ثنيات الوداع
طلع الشكر علينا // ما دعى لله داع
ايها المبعوث فينا // جئت بالامر المطاع
جئت شرفت المدينه // مرحبا يا خيرداع
অর্থ:
আমাদের উপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে # সানিয়া উপত্যকা থেকে।
আমাদের উপর কৃতজ্ঞতা আবশ্যক # যে আল্লাহ তরে আমাদেরকে আহ্বান করে।
হে আমাদের প্রতি প্রেরিত রাসুল! # আপনি আনুগত্য যোগ্য বিষয় নিয়ে এসেছেন।
আপনি মদিনাকে সম্মানিত করেছেন # হে উত্তম আহ্বানকারী! আপনাকে স্বাগতম।
আনসারগণ মহানবী সা.এর উটনীর আশেপাশে ভিড় জমাতে লাগলেন। প্রত্যেকেই কামনা করতে লাগলেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার বাড়িতে মেহমান হবেন। তারা মহানবী সা.-এর উটনীর লাগাম ধরলে মহানবী সা. তাদেরকে বলেন: তোমরা তাকে ছেড়ে দাও, সে আদিষ্ট।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উটনী চলতে লাগলো। তা নাজ্জার গোত্রের দুই ইয়াতিমের জমিনে বসে গেল; যা আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর বাড়ির নিকটবর্তী ছিল।
আবু আইয়ুব আনসারী রা. খুশিতে উড়তে লাগলেন, যখন তিনি তার বাড়ির নিকটে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উটনী দেখতে পেলেন। তিনি দ্রুত এসে রাসুল সা.-এর আসবাবপত্র হাতে নিয়ে নিলেন এবং তা নিজ গৃহে রাখলেন। রাসুল সা. তার বাড়িতে মেহমান হন।
ইয়াসরিব থেকে মদিনা
মদিনার পূর্ব নাম ছিল ইয়াসরিব, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমনে আনন্দিন হয়ে আনসারগণ সেদিন থেকে মদিনা কে ‘মদিনাতুর রাসুল’ বা রাসুলের নগরী নামে নামকরণ করেন।
মদিনার মসজিদে নববী নির্মাণের ইতিহাস
মদিনা হিজরতের পর সর্বপ্রথম মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মসজিদে নববী নির্মাণ করেন। আর মসজিদটি সে জায়গায় নির্মাণ করেন যেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর উটনী বসেছিল। জায়গায়টি দুই ইয়াতিমের ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে তা ক্রয় করেন। তারপর মুসলমানগণ সেখানে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন।
মসজিদে নববী নির্মাণে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অংশগ্রহণ
নির্মাণ কাজে স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম অংশগ্রহণ করেন। তিনি তার বরকতময় কাঁধে প্রস্তরখণ্ড বহন করতেন এবং নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণকারীদের পারিশ্রমিক দিতেন। তাদের জন্য পানাহারের ব্যবস্থা করতেন, যা তাদের সাহস এবং উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিত।
ঈমান, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে কষ্ট, বিরক্তি ছাড়াই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলো। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নিজের উপর এবং অন্যদের উপর কাজ সহজ করার জন্য বারবার এই কবিতাটি পাঠ করতেন।
اللهم لا عيش الا عيش الاخره # فاغفر للانصار والمهاجرة
অর্থ: হে আল্লাহ! পরকালের জীবনই আসল জীবন। আপনি মুহাজির এবং আনসারদের কে ক্ষমা করে দিন।
কয়েক মাসে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলো। তা ছিল সাদাসিধে এমন মসজিদ, যার দেয়ালগুলো ছিল কাঁচা ইটের, দেয়াল ছিল খেজুর কাণ্ডের, ছাদ ছিল খেজুরের ডালের, মেঝে ছিল কঙ্কর ও বালুর। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মসজিদে নববীর পাশে তার স্ত্রীদের জন্য কয়েকটি ঘর নির্মাণ করেন।
যখন মসজিদে নববী এবং ঘরগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর বাড়ি থেকে সেখানে প্রত্যাবর্তন করেন।
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর কুবায় ৪০ দিন অবস্থান করেন। এরই মাঝে তিনি কুবার মসজিদ নির্মাণ করেন। অতঃপর মসজিদে নববী নির্মাণ এবং মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেন। এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বংশীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের চেয়েও শক্তিশালী ও সুদৃঢ় ছিল।
মুহাজির ও আনসারের পরিচয়:
মক্কা থেকে আগত মুসলমানদেরকে মুহাজির নামে নামকরণ করা হয় আর মদিনায় বসবাসরত মুসলমানদেরকে আনসার নামে নামকরণ করা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এই উভয়ের মাঝেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেন। প্রত্যেক আনসারের জন্য মুহাজিরদের মধ্যে থেকে একজন ভাই বানিয়ে দেন। যে তার অর্থ সম্পদ এবং আবাসস্থলে শরিকানা লাভ করত। এতে আনসারগণ আনন্দিত হন, যেমনিভাবে মুহাজিরগণ আনন্দিত হন মহান ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে স্থাপনের মাধ্যমে।
আনসারগণ আগ্রহ ও সন্তুষ্ট চিত্তে তাদের মুহাজির ভাইদের জন্য তাদের অর্থ সম্পদ এবং ভোগ সামগ্রী মাঝে ভাগ করতে লাগলেন। মুহাজিরগণ তাদের থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কিছুই গ্রহণ করতেন না বরং তাদের অধিকাংশই আনসারদের থেকে কোন কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তারা ব্যবসা এবং কাজের দিকে মনোযোগী হন ফলে তাদের প্রশস্ত ব্যবসা এবং অঢেল সম্পত্তি অর্জিত হয়।
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়ে উঠে।
মদিনায় ইসলামী শাসনের সূচনা
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার জীবনকে শৃঙ্খলে নিয়ে আসতে চাইলেন। তবে মদিনার ভূমি মুসলমানদের জন্যই বিশেষ ছিল না বরং সেখানে মুশরিক এবং ইহুদিরাও বসবাস করত। আউস এবং খাজরাজ গোত্রের মাঝে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং তাদের মধ্য থেকে শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম একটি চুক্তিপত্র লেখেন, যা মুসলমানদের মাঝে পরস্পর সম্পর্ককে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে পরিণত করল।
পরিশেষে আল্লাহ তায়ালার অশেষ নিয়ামতে তারা একে অপরের প্রতি উদার এবং পরোপকারী হয়ে গেল। যেমনিভাবে এই চুক্তিপত্র মুসলমানদের সাথে মুশরিক এবং ইহুদিদেরকে মদিনা রক্ষা, তার উপর প্রত্যেক সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতিহত করা, শত্রুদেরকে সাহায্য না করার উপর বাধ্য করল।
বিষয়টি মদিনায় স্থির হল। ফলে, মদিনা মুসলানদের জন্য একটি ছোট রাষ্ট্রে পরিণত হলো। যার আশ্রয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অধীনে বিভিন্ন গোত্র বসবাস করত।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের অনুমতি
ইহুদিরা তাদের কৃত ওয়াদা উপর অবিচল রইল না। তারা ওয়াদা ভঙ্গ করলো এবং কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর উসকিয়ে দিতে লাগলো। মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির চেষ্টা করলো। ফলে সর্বদিক থেকে মুসলমানদের জীবন মদিনায় সংকটের মুখে পড়ল। এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা জিহাদের আয়াত নাজিল করে মুসলমানদেরকে জিহাদের অনুমতি দেন।
قال الله تعالى: أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ