নবুওয়াতের ১১ তম বৎসর হযরত মুহাম্মদ সা. হজ্জের মওসুমে মক্কায় আগত কাফেলাদের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মিনায় আকাবার নিকটে মদিনা থেকে আসা ১১জন লোকের সাথে মিলিত হন।
তাদের সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং কুরআনুল কালীম থেকে বিভিন্ন আয়াত পাঠ করে শুনান। ফলে তারা বিশ্বাস করল যে, তিনি আল্লাহর নবী, যার আবির্ভাবের ব্যাপারে ইহুদিরা আলোচনা করে। আল্লাহ তাআলা এ সকল ব্যক্তিদের অন্তর ঈমানের জন্য প্রশস্ত করে দেন। ফলে তারা আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্যতা স্বীকার করে নেয়।
তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করে ইসলামের প্রতি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে লাগল। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব হওয়ার বিষয়টি মদিনায় ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি মদিনার কোন ঘর বাকি ছিল না যেখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম-এর ব্যাপারে আলোচনা হত না।
প্রথম বাইয়াতে আকাবা
পরবর্তী বছর হজের মৌসুমে মদিনা থেকে ১২ জন লোক মক্কায় আগমন করেন। তারা হযরত মুহাম্মদ সা.-এর কাছে মিনায় আকাবাতুল উলার নিকট সাক্ষাৎ করেন এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য এবং দ্বীনী কাজের সাহায্য করার ব্যাপারে রাসুল সা.-এর নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ হোন। এই বাইয়াতকে ‘প্রথম বাইয়াতে আকাবা’ বা ‘বাইয়াতুল আকাবাতিল উলা’ নামে নামকরণ করা হয়।
হজের মৌসুম সমাপ্ত হলে রাসুল সা. মুসআব ইবনে উমাইর রা. কে সপরিবারে মদিনায় প্রেরণ করেন। যেন তিনি তাদেরকে কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা এবং দ্বীনি অন্যান্য হুকুম-আহকাম শিক্ষা দিতে পারেন। তার হাতে অধিকাংশ মদিনাবাসীর হেদায়েতের পথে ফিরে আসে। এমনকি মদিনার কোন ঘর অবশিষ্ট রইল না, যেখানে এমন একজন ব্যক্তি নেই, যিনি আল্লাহ তায়ালাকে এক বলে বিশ্বাস করবে।
দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা
নবুয়তের ১২ তম বছরে হজের মৌসুমে মদিনার মুসলমানদের থেকে ৭৩ জন পুরুষ এবং দুইজন মহিলা মক্কায় আগমন করে এবং তারা রাসুল সা.-এর সাথে (দূরে মুশরিকদের চক্ষুর আড়ালে, যারা হযরত মুহাম্মদ সা. এবং তার সাক্ষীদেরকে কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারে ওত পেতে বসেছিল) আকাবার নিকট রাত্রে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হন। রাসুল মদিনা থেকে আগত দলের সাথে নির্দিষ্ট সময় সাক্ষাৎ করেন। তারা রাসুল সা. কে স্বাগত জানায় এবং সকলেই এ বিষয়ে বাইয়াত হন যে, তারা নবী সা. কে রক্ষা করবে, সাহায্য করবে এবং আগত বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়াবে, যেমনি ভাবে তারা তাদের অর্থ-সম্পদ, সন্তানাদি এবং মহিলাদের বিপদে পাশে দাঁড়ায়।
তারা নবী সা.-এর সাথে যুদ্ধ করবে, যারা নবী সা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দিবে, নবী সা. যাদেরকে নিরাপত্তা দেন। এই বাইয়াতকে ‘দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা’ বা ‘বাইয়াতুল আকাবাতিস সানী’ নামে নামকরণ করা হয়।
যখন কুরাইশরা বাইয়াতে আকাবায়ে সানী বিষয়টি জানতে পারল এবং মদিনাবাসীদের সাথে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর চুক্তির বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত হল। তখন তারা তাদের নিজেদের অবস্থান এবং এই চুক্তির ফলে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কা বোধ করল।
ধর্ম থেকে ফিরে আসা পর্যন্তা তারা মুসলমানদেরকে কাঠিন্য ও রূঢ়তা মাধ্যমে শাস্তি দিতে লাগলো। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম যখন তার শাস্তি সাথীদেরকে কষ্ট ভোগ করতে দেখলেন তখন তিনি তাদেরকে মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরতের অনুমতি দেন।
মুসলমানগণ মক্কায় তাদের সহায়-সম্পত্তি, অর্থ-সম্পদ সবকিছু পিছনে ফেলে রেখে গোপনে মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত হন।
নবীজির মদিনায় হিজরত:
কুরাইশ নেতৃবর্গ যখন বুঝতে পারল যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম অচিরেই তার সাথীদের সাথে মদিনায় মিলিত হবেন। তারা দারুন নদওয়ায় বড় বৈঠক ডাকল; নবীজি সা. ও তার দাওয়াত প্রতিহত করার ব্যাপারে পরামর্শের জন্য।
এর উপর তাদের সিদ্ধান্ত স্থির হলো যে, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন শক্তিশালী যুবক বেরিয়ে আসবে, যার হাতে ধারালো তরবারি দেওয়া হবে, অতঃপর তারা হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উপর আঘাত হানবে এবং তাকে হত্যা করবে। তার রক্ত গোত্রগুলোর মাঝে ভাগাভাগি হয়ে যাবে। তার পরিবারের কেউই সকল গোত্র থেকে প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হবে না।
হিজরতের অনুমতি প্রদান:
যেদিন কাফেররা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে হত্যার ব্যাপারে নির্ধারণ করেছিল, জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সংবাদ প্রদান করেন এবং তাঁকে আদেশ দেন, তিনি যেন সে রাতে তার গৃহে অবস্থান না করেন।
তাকে সুসংবাদ দেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে মদিনায় হিজরতের অনুমতি দিয়েছেন। হিজরতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করলেন। দুপুরে রাসুল সা. আবু বকর রা. বাড়িতে গেলেন এবং তাকে সুসংবাদ দেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে হিজরতের অনুমতি দিয়েছেন এবং তিনি এই বরকতময় সফরে তার সঙ্গী হবেন।
আবু বকর রা. আনন্দের আতিশয্যে কান্না করতে লাগলেন। রাসুল সা. তার গৃহে ফিরে এসে রাত্রি আগমনের অপেক্ষা করতে লাগলেন।
নবী সা:-কে হত্যার ষড়যন্ত্র
হযরত মুহাম্মদ সা.কে হত্যার উদ্দেশ্যে কুরাইশরা সমবেত হতে লাগল। রাসুল সা. হযরত আলী রা. কে মক্কায় অবস্থানের আদেশ দেন। যেন তিনি ঐ সকল আমানত বুঝিয়ে দিতে পারেন, যা রাসুল সা.-এর নিকট গচ্ছিত ছিল। রাসুল সা. ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে কাফেররা তাকে হত্যা করার জন্য এবং ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য তার ঘর ঘিরে রেখেছিল।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে তাদের থেকে রক্ষা করলেন। তিনি নিজ গৃহের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন এবং তাদের কাতারগুলোর মাঝে দিয়ে অতিক্রম করলেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের চক্ষু অন্ধ করে দিলেন। ফলে কেউ তাকে দেখতে পেলো না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وجعلنا من بين ايديهم سدا ومن خلفهم سدا فاغشيناهم فهم لا يبصرون
গারে সাওরে মহানবী সা.-এর আত্মগোপন:
হযরত মুহাম্মদ সা. হযরত আবু বকর রা.-এর গৃহে গেলেন। তারা উভয়ে মিলে দক্ষিণ দিকে রওনা হন। এমনকি একটি গুহায় পৌঁছান। যাকে ‘গারে সাওর’ বলা হয়। অতঃপর সেখানে তিন দিন আত্মগোপনে থাকেন। আবু বকর রা.-এর ছেলে আব্দুল্লাহ তাদের নিকটের একের পর এক কুরাইশদের বিভিন্ন সংবাদ প্রদান করতেন।
তার বোন আসমা তাদের জন্য খাদ্য ও পানীয় নিয়ে যেতেন। আবু বকর রা.এর গোলাম আমির বিন ফোহাইরা, সে তার মনিবের বকরীগুলো তাদের পায়ের চিহ্নের উপর দিয়ে চড়াতো; যেন কোন নিদর্শন বাকি না থাকে; যা কাফেরদেরকে গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
যখন মুশরিকরা জানতে পারলো যে, হযরত মুহাম্মদ সা. তাদের থেকে ছুটে গিয়েছেন তখন তাদের পাগলামি বেড়ে গেল। তারা সব জায়গায় তাকে খুঁজতে লাগলো। যখন তারা রাসুল সা.-এর নাগাল পাওয়া হতে নিরাশ হয়ে গেল তখন বিরাট পুরস্কার ঘোষণা করল, যার পরিমাণ ছিল ১০০ উট; ঐ ব্যক্তির জন্য, যে রাসুল সা. এবং তার সাথী আবু বকর রা.-এর ব্যাপারে সংবাদ দিতে পারবে।
পাহাড়-উপত্যকা, সমতল-উঁচু, সব জায়গায় তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে তালাশ করতে লাগলো। অনেক কষ্ট ও ক্লান্তি শেষে তারা গুহার মুখে পৌঁছল। যখন আবু বকর রা. তাদের আওয়াজ শুনতে পেলেন, তিনি চিন্তিত হয়ে বললেন: হে আল্লাহর রাসুল! যদি তাদের কেউ তার পায়ের নিচে তাকায় তাহলে আমাদেরকে দেখতে পাবে। রাসুল সা. বললেন: তোমার ঐ দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কি ধারণা, যাদের তৃতীয় জন হলেন আল্লাহ তায়ালা।
তাদেরকে খুঁজে না পেয়ে তারা ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে মক্কায় ফিরে গেল।
হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত
হযরত মুহাম্মদ সা. এবং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিতকে পারিশ্রমিক দিয়ে নিযুক্ত করেন। সে মুশরিক ছিল। হযরত মুহাম্মদ সা. মরুভূমির পথে তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। উভয়েই তার নিকট দুটি উট অর্পণ করেন এবং যেগুলো নিয়ে তিন দিন অতিক্রম হওয়ার পর গুহার মুখে সাথে সাক্ষাৎ করার অঙ্গীকার নেন।
তিন দিন অতিক্রম হওয়ার পর আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিত তার নির্ধারিত সময় দুটি বাহন নিয়ে গুহার এসে পৌঁছেন। প্রথম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে রাসুল সা., তার সাথী আবু বকর সিদ্দিক রা. এবং তাদের সাথে আমের বিন ফুহাইরা ও আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিত মদিনা অভিমুখে বরকতময় যাত্রা শুরু করেন। কাফেরদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ইয়ামেন অভিমুখে দক্ষিণ দিকে আবু বকর ও রাসুল সা. কে নিয়ে আমের বিন উরাইক্বিত যাত্রা শুরু করেন।
অতঃপর লোহিত সাগর ঘেঁষে উত্তর দিকে রওনা হন। তিনি তাদের নিয়ে এমন একটি পথে চললেন, যে পথে সাধারণত কেউ চলাচল করে না। তবে কোরাইশদের রক্তচক্ষু শীতল হচ্ছিল না।
সুরাকা বিন মালেকের ঘটনা
তারা হন্য হয়ে হযরত মুহাম্মদ সা. ও আবু বকর রা. কে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সেই উপঢৌকনের লোভে, যা কুরাইশ কর্তৃক ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সুরাকা বিন মালেক, যে রাসুল সা.-এর অবস্থান জানামাত্রই ঘোড়া নিয়ে তার পিছে দ্রুত ছুটল।
সুরাকা রাসুল সা.-এর বাহনের নিকটবর্তী হলে ঘোড়ার পা বালুতে তলিয়ে যায় এবং সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। সে বুঝতে পারল যে, আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ তার নবীকে হেফাজত করছে। তিনি উচ্চ আওয়াজে রাসুল সা.-এর নিকট নিরাপত্তা কামনা করতে লাগলেন। রাসুল সা. তাকে নিরাপত্তা দিলেন এবং সে জন্য মুশরিকদেরকে পথ না দেখায়, এ ব্যাপারে অঙ্গীকার নেন।
কাফেলা আল্লাহ তায়ালা নিরাপত্তায় চলতে লাগলো, এমনকি মদিনার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছালো।