নবীজি হযরত মুহাম্মদ সা. ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল সম্মানিত নগরী মক্কাতুল মুকাররমায় জন্মগ্রহণ করেন। অধিকাংশ হাদিস বিশারদগণের মতে তিনি ৮ই রবিউল আওয়ালে জন্ম গ্রহণ করেন। যখন সাইয়্যিদা আমিনা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে জন্ম দেন তখন দাদা আব্দুল মুত্তালিব ভীষণ আনন্দিত হোন। তাঁকে ‘মুহাম্মদ’ নাম রাখেন।
নবীজির পিতার ইন্তেকাল
নবীজি সা.-এর পিতার নাম: আব্দুল্লাহ। রাসুল সা. মায়ের গর্ভে থাকাকালে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ শাম থেকে বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে প্রত্যাবর্তনকালে ইন্তেকাল করেন। মদিনায় তাকে তাঁর পিতার মামাদের বংশ বনু নাজ্জারের নিকটে দাফন করা হয়।
দুধ মাতা হালিমা ও শৈশবে তায়েফ গমন
আরবদের সাধারণ রীতি ছিল যে, তারা তাদের সন্তানদেরকে শৈশবে গ্রামে পাঠিয়ে দিত। যেন শিশুরা শক্তিশালী দেহ এবং বিশুদ্ধভাষী হতে উঠতে পারে। কেননা, বিভিন্ন শহর থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আগত লোকদের কারণে শহরের ভাষা মিশ্রিত ভাষার রূপ ধারণ করেছিল।
রাসুল সা. ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি শৈশবের বড় একটি অংশ তায়েফের বনু সাদ গোত্রে কাটান। দুধ পানের বয়স অতিক্রম করলে তিনি তাঁর মায়ের কোলে ফিরে আসেন। যেন মা দুনিয়া থেকে বিদায় জানানোর পূর্বেই তিনি তাঁর মাকে বিদায় জানাতে এসেছেন।
নবীজির বক্ষ বিদারণের ঘটনা
দুধ পানের বয়স অতিক্রম করার পর নবীজি সা.-এর দুধ মাতা হালিমা সাদিয়া রা. নবীজিকে নিয়ে মক্কায় তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে রেখে যাওয়ার জন্য। হালিমা সাদিয়া রা.-এর হঠাৎ আগমন দেখে চিন্তিত হোন এবং বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেন: ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর কি হয়েছে?’
হালিমা সাদিয়া রা. শান্ত ভাবে বলেন: তাঁর কিছু হয়নি। তবে আমি তাকে আপনার কাছে অধিক নিরাপদ মনে করি।
তিনি আবার জিজ্ঞাসা করেন: কি হয়েছে তাঁর?
হালিমা সাদিয়া রা. বলেন: তাঁর সাথে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে; যা আমাকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।
একদা আমি আমার স্বামীর পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ আমাদের নিকট আমাদের ছেলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এসে বলল: আমার ভাইকে বাঁচাও! মুহাম্মদকে বাঁচাও!
অতঃপর যখন আমরা ঘটনা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে আমাদেরকে বলল:
সাদা পোশাক পরিহিত দুই ব্যক্তি তাকে ধরে মাটিতে শুইছে দিয়েছে। অতঃপর তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে তা হতে কিছু বের করছে।
এ কথা শুনা মাত্রই আমরা তাঁর নিকটে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম: ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমরা তাকে শান্ত এবং ভয় দূর করতে লাগলাম এমনকি এক পর্যায়ে তাঁর ভয় কেটে গেলো।
এ কথা শুনে সাইয়্যিদা আমিনা রাসুল সা. এর কাছে গিয়ে তাকে ভালোবাসায় আগলে নিয়ে বলেন: আল্লাহর শপথ! আমার ছেলে বরকতময়। আমি তাঁর মাঝে অনেক শুভলক্ষণ দেখেছি; যা আমার মনকে ভরে দেয়।
হযরত হালিমা সাদিয়া রা. নবীজি সা. কে তাঁর মায়ের কাছের কাছে রেখে তার গোত্রে ফিরে যান।
হযরত সাইয়্যিদা আমিনা রাসুল সা. কে নিয়ে তাঁর বাবার মামার বংশীয় লোকদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফরের ইচ্ছা পোষণ করেন। শিশু মুহাম্মদ সা.-এর আনন্দ বেড়ে গেল; যখন তিনি তাঁর মায়ের মমতা, মায়া, স্নেহ ও ভালোবাসা উপলব্ধি করতে লাগলেন।
বিরান মরুভূমির কষ্টময়ী সফরে তিনি তাঁর মা থেকে স্বল্প সময়ের জন্যও বিচ্ছিন্ন হননি। কষ্টময়ী দীর্ঘ সফর শেষে এক পর্যায়ে তারা মদিনায় বনী নাজ্জারে পৌঁছেন।
সেখানে সকলেই তাকে সাদরে গ্রহণ করল এবং অভ্যর্থনা জানালো। তিনি সেখানে তাঁর পিতার বিকল্প পেয়ে যান; যিনি তাঁর জন্মের পূর্বেই দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। আনন্দের সাথে তিনি মদিনাতে বেশ কিছু দিন কাটান। এমনকি এক পর্যায়ে আপন বাস ভূমি মক্কায় প্রত্যাবর্তনের সময় ঘনিয়ে আসল।
সাইয়্যিদা আমিনাও মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনিও রাসুল সা.কে একা রেখে পরকালে পাড়ি জমান।
মা হারানোর পর মুহাম্মদ সা. মক্কা ফিরে আসেন। মায়ের মৃত্যুর শোকে তিনি ক্রন্দন করতেন। নিঃস্বতা তার অন্তরে দুঃখ, কষ্টের প্রভাব ফেলতে শুরু করল।
মায়ের মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর থেকে নিঃস্বতার কষ্ট দূর করতে চাইলেন। তিনি তাকে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতায় ঢেকে নেন। তিনি সর্বদা তাকে সাথে রাখতেন। এমনকি কুরাইশদের নেতৃস্থানীয়দের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেও তাকে সাথে নিয়ে যেতেন।
কিন্তু কাল রাসুল সা.-এর জন্য নতুন বিপদ গোপন করছিল। রাসুল সা. যখন আট বছর বয়সে উপনীত হন, তখন তাঁর দাদা পর পাড়ি জমান।
তিনি নতুনভাবে ব্যথিত হোন। নতুনভাবে দুঃখ-কষ্ট তাঁর অন্তরে জায়গা করে নেয়।
রাসুল সা. খেলাধুলার প্রতি আসক্ত হননি যেমনটি তাঁর সমবয়সি মক্কার অন্যান্য ছেলেরা ছিল। তিনি কখনো মূর্তি পূজা করেননি। যেমনটি অন্যরা করতো।
মক্কা শহর সমগ্র আরবে যে গান-বাজনার মজলিসের প্রচলন ছিল; তিনি তাতে গমন করতেন না। তিনি সততা, আমানতদারিতা এবং উত্তম চরিত্রের দৃষ্টান্ত ছিলেন। এমনকি তা মক্কাবাসীদের মাঝে প্রসিদ্ধ হয়ে গেল।
আব্দুল মুত্তালিব এর মৃত্যুর পর নবীজি সা. তাঁর চাচা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে থাকতে লাগলেন। আবু তালেব, যিনি নিঃস্ব এবং অসচ্ছল ছিলেন; আল্লাহ তায়ালা এই বরকতময় এতিমের তত্ত্বাবধানের ফলে তাঁর অর্থ সম্পদে বরকত দান করেন।
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নবীজির সিরিয়া সফর:
রাসুল সা. যখন ১৮ বছর বয়সে উপনীত হন তাঁর চাচা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে শাম অর্থাৎ সিরিয়ায় ভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করেন। রাসুল সা. তাকে তাঁর সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিনতি করেন। আবু তালেব তাঁর প্রতি স্নেহশীল হন এবং তাকে সাথে নিয়ে শামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এটিই ছিল নবীজি সা.-এর শামের উদ্দেশ্যে প্রথম সফর।
কাফেলা মরুভূমি, উপত্যকা পাড়ি দিয়ে আপন পথে চলতে লাগলো। এমনকি কষ্টময়ী দীর্ঘ সফর শেষে শামের উঁচু ভূমিতে গিয়ে পৌঁছল। কাফেলা শামের উপকণ্ঠে একটি গির্জার নিকট যাত্রা বিরত দিল, যেমনটি আরব কাফেলাগুলোর অভ্যাস ছিল।
তাদের নিকট বুহাইরা নামক একজন পাদ্রী আগমন করেন, যিনি তাদেরকে মক্কার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন এবং নিকটবর্তী সময়ে একজন নবীর আবির্ভাব হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেন। যেমনটি পূর্ববর্তী ইহুদী-নাছারাদের পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে বর্ণিত রয়েছে।
যখন বুহাইরা নবীজি সা. কে দেখেন, তখন তিনি তাঁর মাঝে কিছু আলামত দেখতে পান; যা পূর্ববর্তী পবিত্র কিতাবগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং বুঝতে পারেন যে, তিনিই প্রতিশ্রুত নবী। তিনি লোকদেরকে তাঁর অভিভাবক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। লোকেরা তাকে তাঁর চাচার ব্যাপারে সংবাদ প্রদান করেন।
বুরাইরা নবীজি সা. এর চাচা আব্দুল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলেন: এই ছেলে উঁচু মর্যাদার অধিকারী হবেন। তিনি তাকে মক্কায় ফেরত পাঠানোর উপদেশ দেন এবং ইহুদিদের থেকে তাকে নিরাপদ রাখতে বলেন। শাম সফর শেষে নবীজি সা. মক্কায় ফিরে আসেন। যেন তাঁর জীবনে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হলো।