ঘন মেঘ আকাশ ঢেকে নিল, দিগন্তগুলো অন্ধকার, ধূসর বর্ণ ধারণ করল, সূর্য মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন মক্কার পাহাড়গুলো আকাশে চলাফেরা করছে। মরুভূমির স্বচ্ছ বালির উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। দূর থেকে কাবাকে দেখে মনে হচ্ছে চারপাশে জল জমতে শুরু করেছে। যেন অন্ধকার আকাশের পাতার প্রতিফলন।
বৃষ্টির ফোঁটা অবিরাম পড়তে থাকল। মনে হল, যেন তা এমন সুতো যেন তা পৃথিবীর ও আকাশের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করছে। হঠাৎ মক্কার পশ্চিম পর্বত থেকে পানি তীব্রভাবে নামতে শুরু করল এবং তার মুখোমুখি হওয়া সবকিছুকে উৎখাত করতে তীব্র বেগে প্রবাহিত হল। এক পর্যায়ে তা লোকালয়ে প্রবেশ করতে লাগল।
জোয়ার আপন পথে প্রস্তরখণ্ড ও বড় বড় পাথরগুলোকে কাটের টুকরার মত ভাসিয়ে নিতে লাগল। অতঃপর তা মক্কার ঘরগুলোর দিকে ধাবিত হল। ফলে অনেক ঘর-বাড়ি ভেঙে পড়ে।
প্রবাহ কমে যাওয়ার পর, কাবার দেয়ালগুলো প্রকাশ পেতে লাগল। যাতে অনেক ফাটল দেখা দিল।
কুরাইশদের কাবা ঘর বিনির্মাণ
সেই ধ্বংসাবশেষ ও ধ্বংসের মধ্যে একটি প্রশস্ত চত্বরে মক্কার নেতারা এবং কুরাইশদের প্রধানগণ কাবার পুনর্নির্মাণের জন্য সমবেত হন। উপস্থিত অনেকেই কাবার দেয়াল ভেঙ্গে আবার নতুন করে নির্মাণের ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছিলেন, কারণ কাবা তাদের হৃদয়ে একটি মহান স্থান ও মর্যাদার জায়গা ছিল। আর এটি ভেঙ্গে ফেলা এবং পুনর্নির্মাণ করা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু মক্কার নেতাদের সামনে বিকল্প পথ ছিল না।
পরিশেষে, ভয় এবং ভীতি থাকা সত্ত্বেও তারা সেই সাহসী পদক্ষেপটি গ্রহণ করল এবং দ্রুত কাবা পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হল। কুরাইশের নেতৃবর্গ এবং সাধারণ জনগণ সহযোগিতা স্বরূপ কাঠ ও পাথর বহনে অংশ গ্রহণ করেন।
অবশেষে কাবার নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছল। যখন তারা কালো পাথরটিকে আপন জায়গায় স্থানান্তর করতে চাইল, তখন তাদের নিজেদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল। তাদের প্রত্যেকে এই সম্মান পেতে আগ্রহী ছিল এবং প্রতিযোগিতা করতে লাগল।
হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে নবীজির ভূমিকা:
আরব গোত্রগুলোর মাঝে দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল এবং হাজরে আসওয়াদ স্থাপনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, আগামীকাল সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবেন, তিনিই এ ব্যাপারে ফায়সালা করবেন।
পরের দিন নবীজি সা. সর্বপ্রথম মসজিদে প্রবেশ করলেন। এটি দেখা মাত্র সকলে বলে উঠল: তিনিই তো আমাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তাঁর মতামত আমরা গ্রহণ করলাম।
যখন তারা নবীজি সা. কে বিচারক হিসেবে মেনে নিল; তিনি তাঁর চাদর বিছিয়ে দিয়ে তাতে পাথরটি রাখলেন এবং তাদের বললেন: “প্রতিটি গোত্র থেকে একজন এসে যেন চাদরের পার্শ্বে ধরেন।”
যখন পাথরটি তার জায়গায় পৌঁছলো, তখন তিনি তাঁর বরকতময়ী হাতে সেটিকে তার জায়গায় রাখলেন।
নবীজি সা.-এর এই প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের ফলে আরবদের মধ্যে বেধে যাওয়া যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হল। যেন আল্লাহ তায়ালা তাকে এই মহান কাজের জন্য প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন।
হেরা গুহায় নবীজি সা.-এর উপর ওহীর সূচনা
নবীজি সা. একাকিত্ব এবং ইবাদত করা পছন্দ করতেন। হেরা গুহায় নিজেকে নির্জন রেখে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। নিদ্রাহীন রাত-দিন সেখানে কাটাতেন। যখন গুহায় ছিলেন, হঠাৎ একজন ব্যক্তিকে দেখতে পান। এতে তাঁর মনে ভয় ও আতঙ্কের সঞ্চার হল। তিনি আর কেউ নন, বরং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত স্বয়ং জিব্রাইল আ.।
জিব্রাইল আ. তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন: “পড়ুন।”
হযরত মুহাম্মদ সা. বললেন: ‘আমি পড়তে জানি না।’
জিব্রাইল তাঁর কাছে পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি তাকে বললেন: আমি কী পড়বো?
জিব্রাইল আ. বলেন: “আপনার পালনকর্তার নামে পড়ুন যিনি সৃষ্টি করেছেন।”
রাসুল সা. কে ভয় গ্রাস করে নিল। তিনি দ্রুত ফিরে গেল। রাসুল সা. তাঁর স্ত্রী খাদিজার ঘরে প্রবেশ করলেন। কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়লেন এবং তাকে ঢেকে দিতে বললেন। খাদিজা তাকে ঢেকে দেন। ফলে ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেল। তিনি খাদিজা রা.-এর কাছে তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ দিলেন। তারপর তিনি তাকে তাঁর সাথে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তাওরাতের পণ্ডিত ছিলেন।
ওয়ারাকা মুহাম্মদ সা.-এর দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন যে, তিনি ফেরেশতা জিব্রাইল যাকে আল্লাহ মূসা এবং ঈসা আ.-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপর বলেন: হায়! আমি যদি শক্তিশালী যুবক হতাম, তাহলে আপনাকে আপনার দাওয়াতী কাজে সাহায্য করতাম এবং বিপদাপদে রক্ষা করতাম। নবীজি সা.জিব্রাইল আ. এর আগমনের অপেক্ষায় গুহায় বারবার যেতে থাকলেন। এমনকি তিনি তাঁর কাছে এসে তাঁকে নবী ও নবীজি হওয়ার ব্যাপারে সুসংবাদ প্রদান করেন।
নবীজি সা. লোকদেরকে গোপন ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। প্রথম যুগের মুসলমানেরা গোপনে আরকাম বিন আবু আরকামের গৃহে সমবেত হতেন। ইসলামের জ্যোতি মক্কায় ছড়িয়ে পড়ল। ফলে, কুরাইশরা তাদের পূর্ব পুরুষদের ধর্মের বিপরীত নতুন এই ধর্মের বিপদ অনুভব করল। তাই তারা নবী সা.-এর প্রতি বিশ্বাসী প্রত্যেকের উপর অত্যাচার করতে লাগল।
প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে জন্য সমস্ত ধরনের যন্ত্রণা ও কষ্ট সহ্য করেছিলেন। নবী সা. তিন বছর যাবত মানুষকে ইসলামের দিকে গোপনে আহ্বান করতে থাকেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রকাশ্যে ইসলামের প্রদি আহ্বান করার আদেশ দেন।