আবু বকর রা. ছিলেন মুসলিম উম্মাহর এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ, নবীর অবর্তমানে রাহবার, তাক্বওয়া, খোদা ভীতি, দান, বদান্যতায় সকলের চেয়ে অগ্রগামী। আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর জীবন ছিল বড় বড় সব কীর্তি ও অবদানে পূর্ণ । মাত্র দুই বছরের শাসনকালে চমৎকার কর্মপন্থার মাধ্যমে রেখে গেছেন চিরস্থায়ী কৃতিত্বের ছাপ। যা কিয়ামত পর্যন্ত হয়ে থাকবে অবিস্মরণীয় ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর মুরতাদ হওয়ার ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনানুযায়ী, কুরাইশ ও সাকিফ গোত্র ছাড়া পুরো আরব ইসলামি সাম্রাজ্যের বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। নবুওয়াতের দাবিদাররা বিভিন্ন প্রদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। একদল যাকাত অস্বীকার করে বসে।
মোটকথা, নবুওয়াতের সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরপরই আশঙ্কা দেখা দেয় ইসলামের দীপ নিষ্প্রভ হওয়ার। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তরাধিকারী আবু বকর রা. তার ঈমানী চেতনা, রাষ্ট্রপরিচালনা দক্ষতা এবং অসাধারণ দৃঢ়তার মাধ্যমে শুধু এ প্রদীপকে নিষ্প্রভ হওয়া থেকে নিরাপদই করেননি; বরং হেদায়াতের আলোকবর্তিকার মাধ্যমে গোটা আরবকে আলোকিত করে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে আবু বকর সিদ্দিকই নবীজির পর ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তাই মুসলিম বিশ্বের উপর তার অবদান সবচেয়ে বেশি। ইসলামের শুরুর যুগের দুই খলিফা অর্থাৎ আবু বকর ও উমর রা.-এর শাসনামলে মুসলমানদের আভ্যন্তরীন ফেতনা প্রকাশ পায় নি। উমর রা.-এর ইন্তিকালের পর আভ্যন্তরীন ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, দ্বিতীয় খলিফা উমর রা.-এর যুগে তিনি ইসলামের বিরাট খেদমত আঞ্জাম দেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রোম ও পারস্যের মসনদ উলটে দেওয়া হয়। তবে, এসবের সূচনা হয়েছিল কার হাতে? কবে থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে এমন দৃঢ় মনোভাব তৈরি হয়েছে? কে খেলাফত বিন্যাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন? কে ইসলামকে শত্রদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন?
নিঃসন্দেহে প্রশ্নগুলোর উত্তরে একমাত্র আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর নামই উঠে আসবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি এর যোগ্য ছিলেন ।
ইসলামি খেলাফত গঠনে আবু বকর রা.
ইসলামে সর্বপ্রথম খেলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আবু বকর রা.। তার শাসনকালে যে সব বড় কাজ সম্পাদিত হয়েছে, তাতে শীর্ষ সাহাবিদের ভূমিকা ছিল। তিনি অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সাহাবিদের দারুল খেলাফত থেকে দূরে যেতে দেননি। পরামর্শ সভার তাদের মতামত গুরুত্বে সহিত বিবেচনা করতেন।
উসামা রা. কে আমির নির্ধারণ রাসুল সা. যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন। এটি ছিল রাসুল সা.-এর জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রেরিত সৈন্য বাহিনী। বাহিনী রওনা হওয়ার পর নবীজি সা.-এর মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পেরে পুনরায় মদিনায় ফিরে আসেন। রাসুল সা.-এর দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর পুনরায় রওনা হন। উসামা রা. বাহিনীর সঙ্গে উমর রা.-এর অংশগ্রহণের নাম প্রস্তাব করেছিলেন খোদ রাসুলুল্লাহ সা.। কিন্তু সিদ্দিক রা. উসামা সা.-এর সম্মতিক্রমে উমর রা.-কে পরামর্শের জন্য মদিনায় রেখে দেন।
একইভাবে জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, হযরত উমর রা.-কে খলিফা নিয়োগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে বিচক্ষণ সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তবে ফারুকে আজমের যুগের মতো তখন নিয়মিত কোনো পরামর্শ পরিষদ ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় দেখা দিলে বিচক্ষণ মুহাজির ও আনসারদের একত্রিত করে তাদের থেকে মতামত গ্রহণ করতেন।
ইবনে সাদ বলেন:
“কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এলে আবু বকর রা. পরামর্শের জন্য প্রজ্ঞাবান ও ফকিহ সাহাবিদের পরামর্শ নিতেন। মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে কতিপয় নির্বাচিত ব্যক্তি; যা উমর রা., উসমান রা., আলি রা., আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা., মুয়াজ ইবনে জাবাল রা., উবাই ইবনে কাব রা. ও জায়েদ ইবনে সাবেত রা.-কে ডাকতেন। তারা সবাই আবু বকর সিদ্দিক রা.- এর যুগে ফাতাওয়া প্রদান করতেন।”
– তাবাকাতে ইবনে সাদ: ২/২৬৭
রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিমালা:
রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণের পর রাষ্ট্রকে সুন্দর নীতিমালার অধীনে পরিচালনা, বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করা এবং যোগ্য লোক নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবু বকর রা.-এর যুগে সবেমাত্র বহির্বিশ্ব জয়ের ধারা শুরু হয়েছিল। এজন্য তার শাসনামলে রাষ্ট্রের পরিধি শুধু আরবেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি আরবকে বিভিন্ন জেলা ও প্রদেশে ভাগ করে দেন।
মদিনা, মক্কা, তায়েফ, সানআ, হাজরামাউত, বাহরাইন, দাওমাতুল জান্দালসহ প্রভৃতি আলাদা প্রদেশ ছিল। প্রতিটি প্রদেশের জন্য তিনি ভিন্ন ভিন্ন গভর্নর নির্ধারণ করেন। তারাই সব ধরনের দায়িত্ব পালন করতেন। তবে দারুল খেলাফতে সকল বিভাগের পৃথক দায়িত্বশীল নিযুক্ত ছিলেন। যেমন, শামে সেনাপতি নিযুক্ত হওয়ার আগে আবু উবায়দা রা. অর্থ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ফারুকে আজম রা. ছিলেন কাজি তথা বিচারক। উসমান রা. ও জায়েদ ইবনে সাবেত রা. খেলাফতের দরবারের কাতিব।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যারা যে দায়িত্বে ছিলেন, সিদ্দিকে আকবার রা. তাদেরকেই সেসব পদের জন্য অগ্রাধিকার দেন। যেমন, রাসুলের যুগে মক্কায় আত্তাব ইবনে উসাইদ রা., তায়েফে উসমান ইবনে আবুল আস রা., সানআয় মুহাজির ইবনে উমাইয়া রা., হাজরামাউতে জিয়াদ ইবনে লাবিদ রা., বাহরাইনে আলা ইবনে হাজরামি রা. নিয়োজিত ছিলেন বিধায় আবু বকর রা. তাদেরকে সেই দায়িত্বে বহাল রাখেন।
আবু বকর রা. কাউকে কোনো দায়িত্ব দিলে সাধারণত তাকে ডেকে তার দায়িত্ব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন। প্রভাবব্যঞ্জক ভাষায় তাকে সঠিক পন্থা ও তাকওয়া অবলম্বনের নসিহত করতেন। যেমন: আমর ইবনে আস ও লাবিদ ইবনে উকবা রা.-কে কুজাআ গোত্রের জাকাত উসুলের দায়িত্ব প্রদানের সময় নিম্নোক্ত নসিহত করেন –
“প্রকাশ্য ও গোপন সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করবে। যে আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য পথ খুলে দেবেন। তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দেবেন, যা সে ভাবতেও পারেনি। যে আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। তার প্রতিদান দ্বিগুণ করে দেবেন। নিঃসন্দেহে মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষিতা হচ্ছে সর্বোত্তম তাকওয়া। তোমরা আল্লাহর রাস্তায় রয়েছ। এখানে বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি বা এমন আলস্যের অবকাশ নেই, যার ফলে আমাদের ধর্মের স্থিতিশীলতা এবং খেলাফতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। তাই কখনও অলসতা ও উদাসীনতা করা যাবে না।”
একইভাবে ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান রা.-কে শাম অভিযানের দায়িত্ব প্রদানের সময় বলেন:
“ইয়াজিদ, তোমার নিকটাত্মীয় রয়েছে। হয়ত তুমি নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের কল্যাণ পৌঁছাতে চাইবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাই সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যাকে মুসলমানদের শাসক নিযুক্ত করা হয়, সে যদি যোগ্যতা ছাড়াই স্বার্থের বিবেচনায় কাউকে আমির নিযুক্ত করে, তাহলে তার উপর আল্লাহর লানত । আল্লাহ তায়ালা তার কোনো ওজর-আপত্তি এবং ফিদইয়া কবুল করবেন না । (তার কৃতকর্মের জন্য) তাকে তিনি জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।”
শাসকদের জিজ্ঞাসাবাদ:
রাষ্ট্রের আইনকানুন যতই সুঘটিত হোক, যদি দায়িত্বশীলদের খোঁজ-খবর না নেওয়া হয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ না করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সব নিয়ম শৃঙ্খলা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এজন্যই সিদ্দিক রা. স্বভাবগতভাবে নম্র, শিথিলতা প্রিয় এবং বিভিন্ন বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতার অধিকারী হওয়ার পরও তাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কঠোরতা, যাচাই-বাছাই এবং সকল কিছুর খোঁজখবর নিতে হয়েছে।
ব্যক্তিগত বিষয়ে নম্রতা ও শিথিলতা অবলম্বন ছিল তার চিরন্তন অভ্যাস। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কিংবা ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে শিথিলতা অবলম্বনকে তিনি বৈধ মনে করতেন না। তাই কোনো দায়িত্বশীল থেকে অন্যায় কিছু সংঘটিত হলে তিনি কঠোরভাবে তাকে সতর্ক করতেন।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহাবীদের জীবনী জানতে প্রায় শতাধিক সাহাবী রা.-এর জীবনী সম্বলিত সাহাবী বিভাগে ভিজিট করুন।
মালেক ইবনে মুবায়রা ছিল জাকাত অস্বীকারকারী। তাকে শায়েস্তা করার জন্য খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা.-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু খালেদ রা. মৌখিকভাবে হেদায়াত করার আগেই ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়ে তাকে দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত সৈনিক তাকে হত্যা করে ফেলে। মালিকের ভাই ছিলেন একজন কবি। তিনি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় শোকগাঁথা লিপিবদ্ধ করেন। এতে তুলে ধরেন — মালেক তওবা করতে প্রস্তুত ছিল; কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে । আবু বকর রা.-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে তিরস্কার করেন।
ইসলাম প্রচার-প্রসার:
ইসলাম প্রচার-প্রসার করাই হচ্ছে রাসুলের প্রতিনিধির প্রধানতম কাজ। খেলাফতের দায়ভার কুদরতিভাবেই তাদের মধ্যে ইসলামের প্রচার-প্রসারের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। রোমান ও পারসিকদের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের পাঠানোর সময় খলিফাগণ বলে দিতেন: “প্রতিপক্ষকে সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত দেবে। তেমনই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরব গোত্রগুলোতে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। কেননা আরব হিসেবে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা ছিল তুলনামূলক সহজ।”
তাই দেখা যায় মুসান্না ইবনে হারেসা রা.-এর প্রশংসিত প্রচেষ্টার ফলে বনু ওয়ায়েলের সকল মূর্তিপূজক ও খ্রিষ্টানরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে আসে। একইভাবে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা.-এর দাওয়াতে ইরাক, আরব ও শাম সীমান্তের অধিকাংশ গোত্রগুলো ইসলাম গ্রহণ করে নেয়।
হিরার এক খ্রিষ্টান পাদরি নিজেই ইসলাম কবুল করে। ইয়ামানের আশআস এবং তার সাথিরা ইসলামে দীক্ষিত হয়। নবুওয়াতের দাবিদার তুলাইহাও খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা.-এর মোকাবেলা থেকে পালিয়ে শামে গিয়ে ওজর পেশ করে নিম্নোক্ত কবিতা লিখে তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে জানান দেয়,
فهل يقبل الصديق أني مراجع و معط بما أحدثت من حدث يدي و إني من بعد الضلالة شاهد شهادة حق لست فيها بملحد
“আবু বকর সিদ্দিক কি এই আবেদন গ্রহণ করবেন যে, আমি ইসলামে ফিরে আসি! আমার হাত যে পাপ করেছে তার প্রতিবিধান করি । আমি ভ্রষ্টতার পর সত্য সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা এমন সাক্ষ্য যা থেকে আমি কখনোই আর সরে আসব না।”
এই উজর এবং ঈমানের স্বীকৃতির ফলে তুলাইহার প্রতি আবু বকর রা.-এর মন সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়। তাকে তিনি মদিনায় আসার অনুমতি দেন। কিন্তু তার আসার আগেই সিদ্দিক রা.-এর ইন্তেকাল নিভে যায়।
ফাতাওয়া বিভাগ:
আবু বকর রা. ফিকহি মাসআলা নিয়ে গবেষণা ও নাসেখ-মানসুখের দলিল যাচাই-বাছাইসহ জনসাধারণের সহজতার লক্ষ্যে একটি ফাতাওয়া বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত উমর, উসমান, আলি, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, মুয়াজ ইবনে জাবাল, উবাই ইবনে কাব, জায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ জ্ঞানী ও মুজতাহিদ সাহাবিগণ এ খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তারা ব্যতীত অন্য কারও জন্য ফতোয়া দেওয়ার অনুমতি ছিল না। উমর রা. তার শাসনামলে গুরুত্বের সঙ্গে এই ফতোয়া বিভাগ বহাল রাখেন।
অমুসলিম প্রজাদের অধিকার:
নবীজি সা.-এর যুগে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মুসলিম সাম্রাজ্যে আশ্রয় দেওয়া হয়। বিভিন্ন অঙ্গীকারের মাধ্যমে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। আবু বকর রা. ও অনুরূপভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মুসলিম সাম্রাজ্যে আশ্রয় দেন। তার শাসনামলে যে সব রাষ্ট্র বিজিত হয়, সেখানকার জিম্মিদেরকে তিনি প্রায় মুসলমানদের সমান অধিকার প্রদান করেন।
হিরাবাসীর সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিনামা সংঘটিত হয়েছিল যে, ‘তাদের কোনো উপাসনালয় বা গির্জা ভাঙা হবে না। প্রয়োজনে শত্রুর মোকাবেলার জন্য যে আশ্রয়-প্রাসাদে তারা অবরুদ্ধ হয়, তা ভাঙা যাবে না। ঘণ্টা বাজানোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না। তাদের ধর্মীয় উৎসবের দিন ক্রুশ বের করতে বাধা দেওয়া যাবে না।’ অঙ্গীকারনামা বহু দীর্ঘ । এখানে শুধু সেসব বাক্য উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো মুসলমানদের ইনসাফের প্রমাণ বহন করে।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর যুগে জিজিয়া ও করনীতি ছিল খুবই সহজ। যারা কর আদায়ের সামর্থ্য রাখত, শুধু তাদের ওপরই আরোপ করা হতো। সুতরাং হিরার ৭ হাজার অধিবাসীদের মধ্য থেকে ১ হাজার লোককে করের আওতামুক্ত রাখা হয়। অন্যদের উপর বার্ষিক দশ দিরহাম কর আরোপ করা হয়। অঙ্গীকারনামায় কোনো জিম্মি বৃদ্ধ, পঙ্গু বা নিঃস্ব হয়ে গেলে তাকে জিজিয়া প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বলা হয়, বাইতুল মাল তার ভরণপোষণ বহন করবে। পৃথিবীর কোনো জাতির ইতিহাস কি এমন পক্ষপাতহীন জনকল্যাণমূলক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারবে?
শান্তি ও দণ্ডবিধি:
আবু বকর রা. ছিলেন খুবই কোমল হৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহর রাসুলের যুগে এক ব্যক্তি তার কাছে ব্যভিচারের কথা স্বীকার করলে তিনি বলেন, ‘তুমি কি আমি ছাড়া অন্য কারও কাছে এ কথা স্বীকার করেছ? সে বলে, না । তিনি বলেন, তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা করে নাও। আর গুনাহের কথা গোপন রাখো। আল্লাহ তায়ালাও তোমার গুনাহকে গোপন রাখবেন। কেননা তিনি তো বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন। লোকটি সিদ্দিক রা.-এর পরামর্শ মেনে নিলে প্রস্তারাঘাতের শাস্তি থেকে বেঁচে যেত। কিন্তু সে নবীজির কাছে এসে এক এক করে চার বার এই অপরাধের কথা স্বীকার করে এবং জেনে বুঝে সন্তুষ্টচিত্তেই প্রস্তারাঘাতের শাস্তি মাথা পেতে নেয়।
নিজ শাসনকালেও তার স্বভাবগত নম্রতা অবশিষ্ট ছিল। আস ইবনে কায়েস নবুওয়াত দাবি করেছিল। তাকে বন্দি করে আবু বকর রা.-এর কাছে নিয়ে আসা হয়। সে তাওবা করে জীবনরক্ষার আবেদন করলে আবু বকর রা. শুধু তাকে মুক্ত করেই দেননি; বরং দুধ বোন উম্মে ফারওয়া রা.-এর সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন।
তবে রাজনৈতিকভাবে জনগণের নৈতিকতার প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের জান-মালের নিরাপত্তা প্রদান ছিল খলিফার প্রথম দায়িত্ব। আবু বকর রা. এই জন্য যদিও পুলিশ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেননি; বরং নবী যুগের মতোই বিষয়টি রেখে দিয়েছিলেন।
তথাপি বাড়তি যেটুকু করেছিলেন সেটি হচ্ছে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে পাহারাদারির দায়িত্ব প্রদান করেন। এ ছাড়া কিছু অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে দেন। যেমন: মদ পানের কারণে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্নজনকে বিভিন্ন শাস্তি দিতেন। আবু বকর রা. চল্লিশটি বেত্রাঘাতকে মদ পানের দোষে প্রশাসনিক শাস্তি হিসেবে নির্ধারণ করেন।
তার শাসনামলে মুহাজির ইবনে আবু উমাইয়া ছিলেন ইয়ামামার আমির। একবার তিনি দুই দুইজন গায়িকা— যাদের একজন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে কটূক্তি করছিল এবং একজন মুসলমানদের গালি গালাজ করছিল – অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তাদের হাত কেটে দেন এবং দাঁত উপড়ে ফেলেন । আবু বকর রা. এ ব্যাপারে অবগত হলে রাগান্বিত হয়ে লিখে পাঠান—নিঃসন্দেহে নবীদের কটূক্তি করা জঘন্যতম অপরাধ। যদি তুমি তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করতে, তাহলে আমি তাকে হত্যার নির্দেশ দিতাম।
কেননা, সে মুসলিম হলে নবীকে গালি দেওয়ার কারণে মুরতাদ হয়ে গেছে এবং জিম্মি হলে সে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। আর যে মহিলাটি কেবল মুসলমানদের মন্দ বলত, তাকে শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি। সে মুসলমান হয়ে থাকলে, তাকে সতর্ক করার জন্য সামান্য শাস্তি দেওয়াই যথেষ্ট ছিল, আর জিম্মি হয়ে থাকলে যখন তার সবচেয়ে বড় অপরাধ শিরককে আমরা উপেক্ষা করে যাচ্ছি, এমতাবস্থায় সামান্য মন্দ বলার কারণে কি শাস্তি দেওয়া যায়?
যদি এটা তোমার প্রথম কোনো ভুল না হতো, তাহলে তোমাকে এর মাশুল ভুগতে হতো। মনে রাখবে, অঙ্গবিকৃতি করা থেকে সবসময় বেঁচে থাকবে। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্যতম গুনাহ। শুধু কিসাসের ক্ষেত্রেই এর সম্ভবপূর্ণ অঙ্গে এর সমপরিমাণ কর্তন বৈধতা রয়েছে । – আস সারিমুল মাসলুল : ১/২০০
আর্থিক বিষয়াদি:
নবীজির যুগে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলাদা কোনো বিভাগ ছিল না; বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে যখন যা আসত, তা তখনই বণ্টন করে দেওয়া হতো। আবু বকর রা.-এর যুগেও এ ব্যবস্থা বহাল থাকে। তিনি তার শাসনামলের প্রথম বছর নারী, পুরুষ, স্বাধীন, গোলাম, বিশেষ, সাধারণ—সবাইকে দশ দিরহাম করে প্রদান করেন। দ্বিতীয় বছর আমদানি বাড়লে সবাইকে বিশ দিরহাম করে দেন।
সিদ্দিক রা.-এর ইন্তেকালের পর ফারুকে আজম রা. আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা., উসমান রা. ও অন্য কতিপয় সাহাবিদের নিয়ে সুনাহ নামক স্থানে স্থাপিত বাইতুল মালের খোঁজখবর নিলে, সেখানে মাত্র এক দিরহাম পাওয়া যায়। তারা বলেন: ‘আল্লাহ তায়ালা আবু বকরের উপর রহম করুন। এরপর বাইতুল মালের খাজাঞ্চিকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়, শুরু থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ সম্পদ এসেছে? সে জানায়, দুই লাখ দিনার।
সামরিক ব্যবস্থাপনা:
নবীজির যুগে নিয়মতান্ত্রিক সামরিক ব্যবস্থাপনা ছিল না; বরং প্রয়োজনে সাহাবিগণ নিজ আগ্রহেই জিহাদের পতাকাতলে জড়ো হতেন । তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের জন্য আলাদা আলাদা আমির নিয়োগ করে দিতেন। শামে প্রেরিত মুজাহিদ বাহিনীতে তিনি এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। অর্থাৎ সকল গোত্রের আমির এবং তাদের পতাকা ভিন্ন ভিন্ন ছিল । আমিরুল উমারা পদও তারই তৈরি। হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা. সর্বপ্রথম এই পদ অলংকৃত করেন।
রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে মুজাহিদদের এ শ্রেণিবিন্যাস ফলপ্রসূ হয়। তাদের প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন কাজ ও দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল । খালেদ রা. সেনাদলে নতুন বিন্যাস নীতি নিয়ে আসেন। প্রতিটি উপদলের জন্য তাদের কাজ ও জায়গা নির্ধারণ করে দেন। এর ফলে চরম মুহূর্তে সেনাদলে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়ে থাকে, তার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সৈন্যদের নৈতিক প্রশিক্ষণ:
নবীজি সা. এবং খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে সংঘটিত সকল যুদ্ধ শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির ও তার দীনের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংঘটিত হতো। তাই সৈনিকদের নৈতিকতা কুফফার সৈনিকদের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়, এর প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো । নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর সিদ্দিক রা.-ও সৈন্য গঠনের সময় এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেন। যখনই কোনো বাহিনীকে অভিযানে পাঠিয়েছেন, পায়ে হেঁটে কিছু দূর পর্যন্ত তাদের সাথে যেতেন। সেনাপ্রধানদের গুরুত্বপূর্ণ নসিহতের পরই বিদায় জানাতেন।
শামে অভিযানের সময় তিনি মুজাহিদ বাহিনীর সেনাপতিকে বলেন,
“তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গ পাবে, যারা নিজেদের আল্লাহর ইবাদতের জন্য ওয়াক্ফ করে দিয়েছে। তাদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেবে। আমি তোমাকে দশটি ওসিয়ত করছি। কোনো নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করবে না। কোনো ফলদার গাছ কাটবে না। কোনো জনপদকে বিরান করবে না। আহার ব্যতীত অন্য কারণে কোনো বকরি বা উট জবাই করবে না । কোনো খেজুর বাগান জ্বালাবে না। গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। কখনও ভীতু হবে না।” [– তাবাকাতে ইবনে সাদ: ৩/১৬০]
যুদ্ধ সরঞ্জামের ব্যবস্থাকরণ:
বিভিন্ন জায়গা থেকে যা আয় হিসেবে আসত, আবু বকর রা. তার একটি অংশ দিয়ে যুদ্ধ সরঞ্জাম এবং অস্ত্র ক্রয় করতেন। উট-ঘোড়া প্রতিপালনের জন্য নাকি’ নামক স্থানে একটি চারণভূমি প্রস্তুত করেন। এতে হাজারো প্রাণী প্রতিপালিত হতো। রাবজাহ নামক স্থানে একটি চারণভূমি ছিল। এখানে সদকা ও জাকাতের পশু চড়ানো হতো ।