আবু বকর সিদ্দিক রা. ৬৩ বছর বয়সে জুমাদাস সানি মাসের সোমবারে ইন্তেকাল করলে উমর বিন খাত্তাব রা. খেলাফতের আসনে সমাসীন হন। পূর্ববর্তী খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর যুগে নবুওয়াত দাবিদার, আরবের মুরতাদ গোষ্ঠী এবং জাকাত অস্বীকারকারীদের দমন শেষে দেশসমূহ বিজয়ের ধারা শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ দ্বাদশ হিজরিতে ইরাকে সেনা অভিযান শুরু হলে হিরার সকল প্রদেশগুলো বিজিত হয়। তেমনই ত্রয়োদশ হিজরিতে শামে হামলা চালানো হলে মুসলিম মুজাহিদগণ সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন।
ইরাক বিজয়:
উমর রা. খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পরপরই প্রথমেই ইরাক বিজয় পূর্ণতা দানের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তার হাতে বাইয়াতের জন্য আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষ এসেছিল। তিনি এক জনসমাবেশে যুদ্ধের দীর্ঘ এক ভাষণ দেন। যেহেতু সকলেই জানতেন ইরাকে পারস্য সাম্রাজ্যের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে, আর তা জয় করা সহজ কাজ হবে না, তাই কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। উমর রা. ধারাবাহিক কয়েকদিন মানুষকে যুদ্ধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
অবশেষে চতুর্থ দিন এমন মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন যে, এতে সবার মন নরম হয়ে যায়। তখন মুসান্না শায়বানি জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে মুসলমানগণ! আমি অগ্নিপূজকদের পরীক্ষা করে নিয়েছি, তারা ময়দানের বীরপুরুষ নয়। আমরা ইরাকের বড় অঞ্চল জয় করে ফেলেছি। তারা এখন আমাদেরকে অপরাজেয় মনে করছে। একইভাবে তখন সাকিফ গোত্রের সর্দার আবু উবায়েদ সাকাফি জিহাদের জজবায় অনুপ্রাণিত হয়ে বলেন, ‘আমরা তো এই যুদ্ধের জন্যই।’ আবু ওবায়েদের বাইয়াত গ্রহণ উপস্থিত সকলকেই উদ্দীপ্ত করে তোলে। চারদিক থেকে আওয়াজ আসতে থাকে আমরাও এর জন্য উপস্থিত।
উমর রা. তখন মদিনা ও এর আশপাশ থেকে ১ হাজার বর্ণনান্তরে ৫ হাজার মুজাহিদ নির্বাচন করে আবু উবায়েদ সাকাফিকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং তাকে ইরাকে পাঠান।
আবু উবায়েদ সাকাফি পৌঁছার আগেই রুস্তম ফুরাতের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে মুসলমানদের প্রতি বিদ্রোহী করে তোলে। ফলে ওখানকার যে সব অঞ্চল ইতিপূর্বে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন ছিল, তা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। বুরান দুখত আরও একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে। নার্সি ও জাবানকে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করে রুস্তমের সাহায্যে পাঠিয়ে দেয়।
দুই সেনাপতি দুই পথ ধরে এগিয়ে আসতে থাকে । জাবানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী নামাজিক নামক স্থানে পৌঁছেই আবু উবায়দা রা.-এর বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। তাদের বিখ্যাত নেতা জাওশানশাহ ও মরদানশাহ যুদ্ধে নিহত হয়। জাবান গ্রেফতার হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি তাকে পাকড়াও করেছিল, সে তাকে চিনত না বিধায় সে বেঁচে যায়।
জাবান গ্রেফতারকারীকে বলে— এই বৃদ্ধ বয়সে গ্রেফতার হয়ে আমি তোমার কী সেবা করব। এর চেয়ে ভালো, তিনি আমাকে দুটি ক্রীতদাসের বিনিময়ে মুক্ত করেন। লোকটি তার প্রস্তাবে রাজি হলো। পরে যখন জানা যায় এই লোকটিই ছিল শত্রুপক্ষের সেনাপতি জাবান, তখন লোকজন শোরগোল করে বলতে থাকে, এমন শত্রুকে মুক্ত করা উচিত হয়নি। আবু উবায়েদ সাকাফি বলেন, ইসলামে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা জায়েজ নয়।
আবু উবায়েদ সাকাফি জাবানকে পরাজিত করার পর সাকাতিয়ায় নার্সির বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেন। এর ফলে আঞ্চলিক নেতৃস্থানীয় লোকেরা স্বেচ্ছায় আবু ওবায়দের আনুগত্য করা শুরু করে। নাসি ও জাবানের পরাজয় সংবাদ শুনে রুস্তুম মরদানশাহকে চার হাজার সৈন্য দিয়ে আবু উবায়েদের মোকাবেলায় পাঠায়। এ সংবাদ জানতে পেরে আবু উবায়েদ ফুরাত পাড়ি দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালিয়ে বসেন।
নদীর ওই পাড়ের ময়দান ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ও যুদ্ধের অনুপযোগী অসমতল। এ ছাড়াও আরবের অশ্বারোহীদের প্রথমবারের মতো পাহাড় সদৃশ ইরানি হাতির মোকাবেলায় অবতীর্ণ হতে হয়। ফলে মুসলিম বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। ৯ হাজার বাহিনী থেকে মাত্র ৩ হাজার মুজাহিদ জান নিয়ে বেঁচে আসতে সক্ষম হন।
এই পরাজয় উমর রা.-কে প্রচণ্ড রাগিয়ে দেয়। তিনি মর্মর্ষী ভাষণের মাধ্যমে আরবের সকল গোত্রে যেন আগুন ধরিয়ে দেন। তার ভাষণ এতটাই তেজস্বী ছিল যে, এর ফলে নামির ও ভাগলিব গোত্রের খ্রিষ্টান সর্দাররাও এই বলে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেয় যে, আজকের যুদ্ধ আরব ও অনারবের যুদ্ধ । এটা জাতীয় যুদ্ধ বিধায় আমরা আমাদের জাতির সঙ্গ দিচ্ছি। উমর ফারুক রা. তখন জারির ইবনে আবদুল্লাহ বাজালি রা.-এর সেনাপতিত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেন। এদিকে মুসান্না রা.-ও সীমান্তের আরব গোত্রগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন।
মুসলমানদের এই প্রস্তুতির সংবাদ পেয়ে বুরান দুখতও তার বিশেষ বাহিনী থেকে ১২ হাজার বাছাই করা যোদ্ধাকে মিহরান ইবনে মাহরাবিয়ার নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দেয়। হিরার পাশে উভয় পক্ষ যুদ্ধের জন্য কাতারবন্দি হয়ে দাড়ালে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ইরানিরা পরাজিত হয়। মিহরান ইবনে তাগলিব এক যুবকের হাতে নিহত হয়। এ বিজয়ের পর মুসলমানগণ গোটা ইরাকে ছড়িয়ে পড়েন।
ইরানের রাজধানীতে এ সংবাদ পৌঁছলে তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাদের শাসনব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন । বুরান দুখতকে পদচ্যুত করে ক্ষমতায় বসিয়ে নেওয়া হয় ১৬ বছর বয়েসি কিশোর শাহজাদা ইয়াজদাগিরদকে। রাষ্ট্রের সভাসদরা পরস্পর মিলেমিশে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে। দুর্গ এবং সামরিক ক্যাম্প শক্তিশালী করা হয়। মুসলমানদের হাতে বিজিত অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় । এর ফলে ইরানি সাম্রাজ্যে নব চেতনা তৈরি হয়।
একসময় সকল বিজিত এলাকা মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। মুসান্না রা. তখন বাধ্য হয়ে আরবের সীমান্তে সরে আসেন । এরপর ইরাকের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রবিয়া এবং মুজার গোত্রের লোকজনকে ইসলামি পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার আবেদন জানান। এ ছাড়া পারসিকদের প্রস্তুতি সম্পর্কে খেলাফতের কেন্দ্রকে বিস্তারিত অবহিত করেন।
উমর রা. ইরানিদের প্রস্তুতির সংবাদ শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মামাতো ভাই হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.-কে ইরাক যুদ্ধ পূর্ণতা দেওয়ার জন্য ২০ হাজার মুজাহিদ সঙ্গে দিয়ে প্রেরণ করেন। যুদ্ধটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে প্রায় ১৭ জন বদরি সাহাবি অংশগ্রহণ করেন। অনুরূপ ছিলেন বাইয়াতে রিজওয়ানে অংশগ্রহণকারী ৩০০ সাহাবি। তারা এ যুদ্ধে নিজেদের সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
একইভাবে ছিলেন মক্কা বিজয়ে উপস্থিত ৩০০ সাহাবি। আর ছিলেন ৭০০ এমন নওজোয়ান। শিরাফ নামক স্থানে পৌঁছে সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. শিবির স্থাপন করেন। ওদিকে মুসান্না জি-কার নামক স্থানে ৮ হাজার মুজাহিদ সঙ্গে নিয়ে তাদের সাহায্যের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি ইন্তেকাল করলে তার ভাই মুআন্না শিরাফ নামক স্থানে এসে সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মুসান্না প্রয়োজনীয় যে সব পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি সেগুলো সাদ রা.-এর কাছে বর্ণনা করেন।
জাহেলি যুগে উমর রা. ইরাকের প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করেছিলেন বিধায় তিনি ওখানকার অলিগলি সম্পর্কে ছিলেন সম্যক অবহিত। এজন্যই তার বিশেষ নির্দেশ ছিল, যেখানেই সেনা শিবির স্থাপন করা হবে, বিস্তারিত বিবরণ লিখে যেন তার কাছে পাঠানো হয়। সে হিসেবে সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. সেখানকার মানচিত্র এবং সেনাবাহিনীর বণ্টন, অবস্থান ও রসদের বিবরণ লিখে উমর রা.-কে অবগত করেন।
এর উত্তরে খলিফার পক্ষ থেকে এক বিস্তারিত উত্তর আসে। এতে তিনি মুজাহিদ বাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনা, বাহিনী গঠন ও বণ্টনের জরুরি নির্দেশনা দেন। এর পাশাপাশি তিনি তাদেরকে শিরাফ থেকে এগিয়ে কাদিসিয়ার ময়দানে এমনভাবে ছাউনি স্থাপনের নির্দেশ দেন, যাতে সামনের দিকে থাকে পারস্য ভূখণ্ড আর পেছনে থাকে আরব অঞ্চলের পাহাড়। যাতে প্রয়োজনে ওখানে আশ্রয় নেওয়া যায়।
রুস্তম ৬০ হাজার বাহিনী নিয়ে সাবাতে অবস্থান করছিল। ইয়াজদাগিরদের নির্দেশ সত্ত্বেও যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে কাল বিলম্ব করছিল। মুসলমানরা তখন আশপাশে হামলা চালিয়ে তাদের রসদের জন্য পশু সংগ্রহ করছিলেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল হতে থাকলে রুস্তম মোকাবেলায় আসতে বাধ্য হয়। ইরানিরা তখন সারা থেকে বেরিয়ে কাদিসিয়ায় এসে শিবির স্থাপন করে।
কাদিসিয়ায় পৌঁছে রুস্তম রুস্তম যুদ্ধ এড়াতে দীর্ঘ সময়ের জন্য দূতাবাস বিনিময় এবং কূটকৌশল অব্যাহত রাখে। তবে, মুসলমানদের একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত ছিল যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে বা জিজিয়া দিতে রাজি না হয় তবে তরবারিই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।। রুস্তম যুদ্ধ এড়াতে তার সমস্ত প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে উত্তেজিতভাবে বলে: সূর্যের কসম! আগামীকাল আমি সমস্ত আরবকে হত্যা করব।
কাদিসিয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধ:
উত্তেজিত রুস্তম তার বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়। সারারাত সে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কাটিয়ে দেয়। সকালে কাদিসিয়ার মাঠে পারসিক সৈন্যরা প্রবেশ করে। তাদের সাথে ছিল ভয়ংকর কালো হাতির পাহাড়। হাতিগুলো এক বিস্ময়কর ভীতি ছাইয়ে রাখছিল।
অপরদিকে মুজাহিদগণ কাতারবন্দি হয়ে প্রস্তুত ছিলেন। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছিল। যথারীতি যুদ্ধ শুরু হয় এবং দিনভর লড়াই চলতে থাকে। সন্ধ্যায় চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেলে উভয় দল নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে যায়। আরব ইতিহাসে কাদিসিয়ার প্রথম দিনের এ যুদ্ধকে ইয়াওমুল আরমাস বলা হয়। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ ইয়াওমুল আগওয়াস নামে খ্যাত।
এই দিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় শাম থেকে ৬ হাজার মুজাহিদ এসে মুসলিম শিবিরে যোগ দেয়। এতে মুসলমানদের আগ্রহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। গোটা দিন যুদ্ধ চলতে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধে মুসলমানদের ২ হাজার মুজাহিদ শহিদ ও আহত হয়। ইরানিদের পক্ষে আহত নিহত হয় ১০ দশ হাজার যোদ্ধা। কিন্তু এদিনও জয় পরাজয়ের কোনো ফায়সালা হয়নি।
তৃতীয় দিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটা ইয়াওমুল ইমাস নামে প্রসিদ্ধ। এই দিন মুসলমানগণ সর্বপ্রথম পাহাড়সম হাতিগুলো থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করেন। কেননা, ইরানিদের মোকাবেলায় মুজাহিদরা এই হাতিগুলোর কারণে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন।
সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. পারসিক নওমুসলিম জাখাম ও সালমের কাছে হাতিগুলোর বিপদ থেকে পরিত্রাণের উপায় জিজ্ঞেস করেন। তারা হাতিগুলোর চোখ ও শুঁড় অকার্যকর করার পরামর্শ দেন। সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. তখন কাকা ইবনে আমর রা., জামাল ও রাবিকে এই দায়িত্ব প্রদান করেন । তারা বর্শার মাধ্যমে হাতির চোখ নষ্ট করে ফেলেন। কাকা রা. এগিয়ে গিয়ে তলোয়ার দিয়ে সাদা হাতির শুঁড়ে প্রচণ্ড আঘাত করেন । হাতির শুঁড় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পাগলের মতো পালাতে থাকে। সাদা হাতির পালানো দেখে সবগুলো হাতি তার পিছু পিছু পলায়ন করা শুরু করে। এভাবে মুহূর্তেই কালো হাতির বিপদ কেটে যায়।
এবার বীর বাহাদুরদের বীরত্ব প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি হয়। সারাদিন তুমুল যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। রাতেও যুদ্ধ চলতে থাকে। রক্তক্ষয়ী সেই প্রচণ্ড যুদ্ধে মুজাহিদদের তাকবির ধ্বনিতে যুদ্ধ মাঠ প্রকম্পিত হতে থাকে । তাই এ রাতকে লাইলাতুল হারির নামে স্মরণ করা হয়। রুস্তুম বীরত্বের সঙ্গেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আঘাতে জর্জরিত হয়ে পালানো শুরু করে। সে পালাতে নদীতে ঝাঁপ দেয়। যাতে নদী সাঁতরে ওপারে যেতে পারে। কিন্তু হেলাল নামক এক যোদ্ধা তাকে পিছু নেয়। তার পা ধরে নদী থেকে তুলে আনে। এরপর তরবারির আঘাতে তাকে হত্য করে । রুস্তুমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পারস্য সাম্রাজ্যের ভাগ্যেরও ফায়সালা হয়ে যায়। ইরানিদের পা টলে ওঠে। মুসলিম বাহিনী অনেক দূরদূরান্ত পর্যন্ত তাদের ধাওয়া করেন।
এরপর মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হয়ে অতিসহজে বাবেল, কুসি, বাহরাশ এবং নওশেরওয়ার রাজধানী মাদায়েন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. হাশেম ইবনে উতবাকে জলুলায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেন। জালুলা ছিল একটি দুর্ভেদ্য জায়গা। এরপর মুসলিম বাহিনী খসরু ও শানুমকে পরাজিত করে শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
কাকা রা. হুলওয়ানে অবস্থান করেন। তিনি ঘোষণা দেন, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করবে বা জিজিয়া দেবে, সে নিরাপদ। তার এই ঘোষণার পর বহু আমির স্বেচ্ছায় সাগ্রহে ইসলাম কবুল করে নেয় । এটাই ছিল ইরাকের সর্বশেষ বিজয়। কেননা এখানেই ইরাকের সীমান্ত শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ব্যাপক সেনা অভিযান:
নিহাওন্দ যুদ্ধের পর উমর রা. চিন্তা করে দেখেন যতদিন রাজ মসনদে কিসরার উত্তরসূরি বিদ্যমান থাকবে, ততদিন ইরানে যুদ্ধ ও ফেতনার আগুন নির্বাপিত হবে না । তাই তিনি ব্যাপক অভিযানের ইচ্ছা করেন এবং নিজ হাতে কয়েকটি পতাকা তৈরি করে খ্যাতিমান কয়েকজন সেনাপতির হাতে তুলে দেন। অতঃপর তাদের বিশেষ বিশেষ সাম্রাজ্যে পাঠিয়ে দেন। তারা বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ করে অঞ্চলগুলো ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসেন।
সাসানি সাম্রাজ্যের সর্বশেষ শাহজাদা ইরান থেকে পালিয়ে চীনের থাকানের দরবারে আশ্রয় নেয়। খাকান তাকে অত্যন্ত সম্মান দেয়। এরপর চীন সম্রাট একদল সৈন্যসহ ইয়াজদাগিরদকে সঙ্গে নিয়ে মুসলমানদের মোকাবেলায় খোরাসান এসে উপনীত হয়। চীনা বাহিনী আহনাফ ইবনে কায়েসের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মুসলমানদের সাহস ও বীরত্ব দেখে সে পিছপা হয়। সে তখন উপলব্ধি করতে পারে এমন বীর, বাহাদুর জাতির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো মোটেও কল্যাণকর নয়। তাই সে তৎক্ষণাৎ তার সেনাদল নিয়ে নিজ সাম্রাজ্যে ফিরে যায়।
শামের বিজয়:
দামেস্কে পরাজয়ের ফলে রোমানরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা চতুর্দিক থেকে সৈন্য জমায়েত করে বিসানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য জড়ো হয়। মুসলমানরা তাদের সামনে ফিহিল নামক স্থানে সেনাছাউনি স্থাপন করেন। খ্রিষ্টানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. দূত হিসেবে যান। তবে সন্ধির কোনো পথ অবশিষ্ট থাকেনি।
অবশেষে চতুর্দশ হিজরির জিলকদ মাসে ফিহিল মাঠে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিশেষত শেষদিনের যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিশেষে এখানেও মুসলমানদের বিজয় হয়। প্রতিপক্ষের পা টলে যায়। মুসলমানগণ জর্দানের সকল শহর- বন্দরে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করে নেয়। জনসাধারণকে জিম্মি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ব্যাপক এলান করা হয়: নিহতদের জানমাল, বাড়িঘর, গির্জা ও উপাসনালয় সব নিরাপদ থাকবে।
দামেশক ও জর্দান বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী হিমস অভিমুখে যাত্রা করে। রাস্তায় বালাবাক্ক, হামা, শিরাজ ও মাআররাতুন নোমান জয় করে তারা হিমসে পৌঁছে শহরটি অবরোধ করে নেয়। হিমসবাসী কিছুদিন পর সন্ধি করে নেয়। সিপাহসালার আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা. উবাদা ইবনে সামেত রা.-কে এখানকার দায়িত্ব দিয়ে লাজ্জাকিয়া (লাতাকিয়া) অভিমুখে যাত্রা করেন। এক বিশেষ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর শক্তিশালী দুর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে আনেন।
হিমস বিজয়ের পর মুসলমানগণ হিরাক্লিয়াসের রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু হযরত উমর রা. তাদেরকে এ বছর অভিযান পরিচালনা করতে নিষেধ করায় মুজাহিদ বাহিনী ফিরে আসে।
ইয়ারমুকের ময়দান এবং শামের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ:
দামেশক, হিমস ও লাজাকিয়ার ধারাবাহিক পরাজয় রোমান সম্রাটকে উত্তেজিত করে তোলে। রোমান সম্রাট তখন রাজকীয় ক্ষমতা দেখাতে পূর্ণোদ্যমে মুসলমানদের মোকাবেলায় চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে উদ্যোগী হয়। ফলে আন্তাকিয়ার ময়দানে যেন বিশাল রোমান বাহিনী সমবেত হয়।
আবু উবায়দা রা. সে ঝড় প্রতিহত করার লক্ষ্যে আমিরদের সঙ্গে পরামর্শে বিজিত সব এলাকা শূন্য করে দামেস্কে শক্তি সন্নিবেশ করেন।
জিম্মিদের থেকে গৃহীত জিজিয়া ফিরিয়ে দেন। কেননা, মুসলমানগণ তখন তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদানে সক্ষম ছিলেন না। এ ঘটনা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের উপর এমনই প্রভাব ফেলছিল যে, তারা অশ্রু ঝরিয়ে বলছিল— আল্লাহ তোমাদের দ্রুত এখানে ফিরিয়ে আনুন ।
বিজিত এলাকা থেকে মুসলমানদের সরে আসার সংবাদ উমর রা.-কে ব্যথিত দেয়; কিন্তু যখন জানতে পারেন সকল আমির ঐকমত্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তিনি প্রশান্ত হন। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! এতেই কল্যাণ রয়েছে। তিনি তখন সাহায্যস্বরূপ সাঈদ ইবনে আমের রা.-কে ১ হাজার মুজাহিদের একটি বাহিনী দিয়ে রওনা করেন। দূতকে মুজাহিদদের প্রতিটি কাতারে কাতারে গিয়ে তার নিম্নোক্ত বাণী পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন,
“হে মুসলমানগণ! উমর তোমাদের সালাম দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন পূর্ণ সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। তাদের উপর বাঘের মতো হামলে পড়বে। তারা যেন তোমাদের কাছে পিঁপড়ার চেয়েও তুচ্ছ মনে হয়। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন, তোমরাই বিজয়ী হবে।”
জর্দানের সীমান্তবর্তী ইয়ারমুকের ময়দান যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল অত্যন্ত উপযোগী। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের জন্য এই মাঠকেই চয়ন করা হয়। রোমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ২ লাখ। তার মোকাবেলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ থেকে ৩২ হাজার। তবে তারা সবাই ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তাদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার মুজাহিদ রাসুল সা.-এর সাহাবী।
যাদের মধ্যে ১০০ সাহাবি ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। অন্য সাধারণ মুজাহিদগণও এমন সব গোত্রের সদস্য, যারা ছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে অতুলনীয়।
ইয়ারমুকের প্রথম দিনের যুদ্ধ ছিল ফলাফলশূন্য, বিজয় কোন পক্ষে আসেনি। ১৫ হিজরির ৫ রজব যখন দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন রোমানরা এতটাই উদ্দীপ্ত ছিল যে, পালাবার চিন্তা যেন মাথায় না আসে; এ লক্ষ্যে তাদের ৩০ হাজার সৈনিক পায়ে বেড়ি পরে যুদ্ধমাঠে অবতীর্ণ হয়।
হাজার হাজার পাদরি ও বিশপরা ক্রুশ হাতে ছিল সামনের সারিতে এগিয়ে আসে। তারা খ্রিষ্টের (ঈসা আ.) নাম নিয়ে সৈন্যদের উদ্দীপ্ত করে তুলে। রোমানরা এমন আবেগ নিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর হামলে পড়েছিল, যার ফলে উভয় পক্ষে তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
পরিশেষে, মুসলমানদের প্রেরণা, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সামনে তাদের ভীত নড়ে ওঠে। যুদ্ধে প্রায় ১ লাখ খ্রিষ্টান নিহত হয়। মুসলমানদের ৩ হাজার মুজাহিদ শহিদ হয়। রোম সম্রাট এ পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে শামকে আল-বিদা বলে কনস্টান্টিনোপলে চলে যায়। এদিকে উমর রা. এ বিজয়ের সুসংবাদ শোনামাত্রই কৃতজ্ঞতার সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।