(الْفِطْرَةُ) ফিতরাত অর্থাৎ ইসলামের ফিতরাত দশটি। আল্লামা কাজি ইয়াজ (রহ.) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন: হাদিসে যে ফিতরাতের কথা বলা হয়েছে; এর ব্যাখ্যা ‘সুন্নতে কাদিম’ বলে করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এ বৈশিষ্ট্যগুলো এমন, যা সকল নবী-রাসুলগণ গ্রহণ করেছেন এবং সকলের শরিয়ত এ ব্যাপারে একমত। এগুলো যেন এমন বৈশিষ্ট্য, যার উপর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লামা সুয়ুতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ফিতরাত শব্দের যত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তন্মধ্যে এ ব্যাখ্যাটি সর্বোত্তম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
ফিতরাত অর্থ কি?
ফিতরাত বলা হয়, মানুষের ঐ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যকে, যে বৈশিষ্ট্যের উপর তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
ইসলামে মৌলিক ফিতরাত দশটি
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ قَصُّ الشَّارِبِ وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ وَالسِّوَاكُ وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ وَقَصُّ الأَظْفَارِ وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ وَنَتْفُ الإِبْطِ وَحَلْقُ الْعَانَةِ وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ ” . قَالَ زَكَرِيَّاءُ قَالَ مُصْعَبٌ وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلاَّ أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ . زَادَ قُتَيْبَةُ قَالَ وَكِيعٌ انْتِقَاصُ الْمَاءِ يَعْنِي الاِسْتِنْجَاءَ
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, দশটি কাজ ফিতরাতের অন্তভুক্ত। গোঁফ খাটো করা, দাঁড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, নাক কানের ছিদ্র এবং আঙ্গুলের গিরাসমুহ ধোয়া, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাড়ির নিচের পশম কাটা এবং পানি দ্বারা ইসতিনজা করা।
হাদীসের রাবী হযরত মুসআব (রা.) বলেন, দশম কাজটির কথা আমি ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। এ হাদীসের বর্ণনায় কুতায়বা আরো একটি বাক্য বাড়ান যে, ওয়াকী বলেন, انْتِقَاصُ الْمَاءِ অর্থ ইস্তিনজা করা।
দশটি ফিতরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা:
قَصُّ الشَّارِبِ অর্থাৎ গোঁফ কর্তন করা। অর্থাৎ উপরের ঠোঁটের উপর গজানো পশমকে একেবারে মূল থেকে না ছেঁটে কেটে নেয়া সুন্নত। তবে গোঁফ কর্তনের ব্যাপারে হাদিসে বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মোচ খাটো করা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে সুন্নত।
إِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ অর্থাৎ, দাড়ি লম্বা করা। সকল নবীগণ দাড়ি রাখতেন। দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং ইসলামের শিআরের অন্তর্ভুক্ত। এক মুষ্ঠির নিচে দাড়ি খাটো করা হারাম এবং কবীরা গোনাহের কাজ।
অনেকেই অজ্ঞতাবশত দাড়ি রাখাকে সাধারণ সুন্নত মনে করেন। দাড়ি রাখা সুন্নতে ওয়াজিবার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এর গুরুত্ব সুন্নতে মুয়াক্কাদার চেয়েও বেশী। তা পরিত্যাগ করলে গোনাহগার হবে।
وَالسِّوَاكُ অর্থাৎ মেসওয়াক করা। মেসওয়াকের মাধ্যমে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। ইমাম মালেক, শাফেয়ী ও আহমদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর মতে, মেসওয়াক করা নামাজের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে মেসওয়াক করা অজুর অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال: لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل وضوء.
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যদি আমি আমার উম্মাতের জন্য কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে না করতাম, তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক ওযুর সাথে মিসওয়াক করার জন্য নির্দেশ প্রদান করতাম। [ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার – ৭৩]
” عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ “
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের উপায়। [-নাসায়ী; হাদিস নং: ১৩৭৫]
اسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ অর্থাৎ নাকে পানি প্রবেশ করানো। অজুতে নাকে প্রবেশ করানো সুন্নত। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে,
أَنَ رَسُولَ الله – صلى الله عليه وسلم – قَالَ: “إِنَّ مِنَ الْفِطْرَةِ الْمَضْمَضَةَ وَالاسْتِنْشَاقَ”.
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কুলি করা এবং নাকে পানি দেওয়া ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত।
►► আরো দেখুন: সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দামার অনুবাদ
►► আরো দেখুন: রাসুল সা.-এর সাহাবীদের জীবন পাতা থেকে
►► আরো দেখুন: খাব্বাব, উমায়ের ইবনে রিয়াব ও আমর ইবনে উসমান রা.-এর জীবনী
قَصُّ الأَظْفَارِ অর্থাৎ নখ কর্তন করা। এটিও ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, নখ কাটার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব পদ্ধতি হল: প্রথমে হাতের নখ কাটা এবং পরে পায়ের নখ কাটা। হাতের মধ্যে আবার প্রথমে ডান হাতের শাহাদাত অঙ্গুলির নখ, এরপর মধ্যমা, এরপর অনামিকা, এরপর কনিষ্ঠা, এরপর বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ কাটবে। তারপর বাম হাতের প্রথমে কনিষ্ঠা, এরপর অনামিকা- এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে বৃদ্ধাঙ্গুলিতে আসবে। এরপর ডান পায়ের কনিষ্ঠা থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে বাম পায়ের কনিষ্ঠায় গিয়ে শেষ করবে।
غَسْلُ الْبَرَاجِمِ অর্থাৎ আঙ্গুলের গিরাসমুহ ধোয়া। অজু ও গোসলের সময় আঙ্গুলের গিরাসমুহ ভালো ভাবে ধৈৗত করা ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত।
نتفُ الإِبطِ অর্থাৎ বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা। বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা সবার ঐকমত্যে সুন্নত। যে ব্যক্তি উপড়িয়ে ফেলতে সক্ষম তার জন্য এটাই উত্তম। তবে কামিয়ে ফেললে বা চুনা দ্বারা তুলে নিলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। পুরুষদের জন্য উপড়ানো আর মহিলাদের কামিয়ে ফেলা উত্তম।
حَلْقُ الْعَانَةِ অর্থাৎ নাভির নিচের পশম কাটা। এটিও সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল: ইসলামী শরিয়ত শুধু ইবাদতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা বিসৃত। বান্দার প্রতিটি কর্ম কিভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে সম্পন্ন হবে। তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ইসলামী শরিয়তে। মানুষের মৌলিক চাহিদা, আচার-ব্যবহার, নম্রতা-ভদ্রতা, তাদীব-তামাদ্দুন সহ দৈনন্দিন যাবতীয় বিষয়াবলির সমাধান ইসলামে রয়েছে। এমনকি একজন মুমিন কিভাবে তার বিশেষ প্রয়োজন সারবে। কোন পদ্ধতিতে বসবে। কোন দোয়া পড়ে বিশেষ প্রয়োজনে সৌচাগাড়ে প্রবেশ করবে। তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। যা অন্য কোন ধর্মে নেই। এর দ্বারা ইসলামের মহত্ত্ব, স্যৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে আসে।
وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ অর্থাৎ পানি দ্বারা ইসতিনজা করা। এটিও সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। পানি দ্বারা ইসতিনজাকারীদের আল্লাহ তায়ালা প্রশংসা করে বলেন:
فِیۡہِ رِجَالٌ یُّحِبُّوۡنَ اَنۡ یَّتَطَہَّرُوۡا ؕ وَاللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُطَّہِّرِیۡنَ
তাতে এমন লোক আছে, যারা পাক-পবিত্রতাকে বেশি পছন্দ করে। আল্লাহ পাক-পবিত্র লোকদের পছন্দ করেন।
হাদিসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আহলে কুবাকে বলেন, আল্লাহ তায়ালা যে তোমাদের তাহারাতের প্রশংসা করেছেন তা কীরূপ?” তারা উত্তরে বলেন, আমরা পানি দ্বারাই ইসতিনজা করে থাকি।” সুতরাং পানি দ্বারা ইসতিনজা করা শুধু সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং মহান রবের সন্তুষ্টিরও কারণ।