খলিফাতুল রাসুল হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে (৫১ হিজরি পূর্ব) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসুল সা.-এর বিশ্বস্ত সঙ্গী, সাহাবী এবং ইসলামের প্রথম খলিফা। রাসুল সা.-এর পর তিনি খেলাফতের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নাম ও বংশ:
নাম: আবদুল্লাহ। উপনাম: আবু বকর। উপাধি: সিদ্দিক ও আতিক। পিতার নাম: উসমান। পিতার উপনাম: আবু কুহাফা। মায়ের নাম: সালমা। উপনাম: উম্মুল খায়ের।
পিতার দিক থেকে বংশীয় সনদ হলো: আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আমের ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তাইম ইবনে মুররা ইবনে কাব ইবনে লুয়াই আল-কুরাশি আত-তামিমি।
মায়ের দিকের বংশীয় সনদ হলো: উম্মুল খায়ের বিনতে সাখার ইবনে আমের ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তাইম ইবনে মুররা। এভাবে ষষ্ঠ পুরুষে গিয়ে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর বংশ, রাসুল সা.-এর বংশ তালিকার সঙ্গে মিলে যায়।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর পিতা:
আবু কুহাফা উসমান ইবনে মুররা ছিলেন মক্কার একজন সম্মানিত ও বয়স্ক ব্যক্তি। মক্কা বিজয় পর্যন্ত আবু কুহাফা পূর্বেন ধর্মে উপর অটল থাকেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে হারামে অবস্থানকালে তিনি আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর সঙ্গে রাসুলের নিকটে উপস্থিত হন। তার বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাকে কেন কষ্ট দিলে, আমিই তার কাছে যেতাম। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু কুহাফার বুকে হাত বুলিয়ে তাকে কালিমায়ে তাইয়্যেবা পাঠ করান।
আবু কুহাফা দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রা.-এর ইন্তেকালের পরও তিনি বেশ কিছু দিন দুনিয়াতে ছিলেন। জীবনের শেষদিকে তিনি অধিক দুর্বল হয়ে পড়েন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। অবশেষে ১৪ হিজরিতে ৯৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মাতা:
তার সম্মানিতা মা সালমা বিনতে সাখার শুরুর দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মাতাও দীর্ঘ জীবন লাভ করেন । তিনি আবু বকর রা.-এর খেলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তবে স্বামীর পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেন ।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর শারীরিক গঠন:
আবু বকর রা. ছিলেন অতি শীর্ণকায়। চেহারা ছিল হালকা-পাতলা। গাত্রবর্ণ ছিল বাদামি। তিনি উঁচু ও প্রশস্ত কপালের অধিকারী ছিলেন। চুলে মেহেদির খেজাব ব্যবহার করতেন।
স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি:
আবু বকর রা. একাধিক বিয়ে করেন। স্ত্রীগণ হলেন:
১. কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা রা.। তার গর্ভে আবদুল্লাহ রা. ও আসমা রা. জন্মগ্রহণ করেন।
২. উম্মে রোমান রা.। তার গর্ভে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. ও আবদুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।
৩. আসমা রা.। তার ঘরে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর রা. জন্মগ্রহণ করেছেন।
৪. হাবিবা বিনতে খারিজা রা.। তার গর্ভে আবু বকর রা.-এর সবচেয়ে ছোট কন্যা উম্মে কুলসুম রা. জন্মলাভ করেন।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর ইসলামপূর্ব জীবন:
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আবু বকর রা. একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। চারদিকে ছিল তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার সুখ্যাতি। প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও সদাচারের দরুন মক্কাবাসী তাকে খুব সম্মান ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করত । তিনি ইসলামি যুগে যেমন মদপানকে ঘৃণা করতেন। মদ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মদপানে মানুষের সম্ভ্রমের ক্ষতি রয়েছে। নবীজি সা. ছিলেন তার শৈশবের বন্ধু। অধিকাংশ ব্যবসায়িক সফরে তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ লাভ করতেন।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর ইসলাম গ্রহণ:
নবুওয়াত লাভের পর যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে ইসলামের কথা প্রচার করতে থাকেন। তখন পুরুষদের মধ্যে আবু বকর রা.-ই সর্বপ্রথম ইসলামের সুশীতল ছায়ার আশ্রয় নেন।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর ইসলাম প্রচার:
আবু বকর সিদ্দিক রা. মুসলমান হওয়ার পর ধর্মের প্রচারে নিজেকে আত্ননিয়োগ করেন। তার দাওয়াতের ফলে হযরত উসমান ইবনে আফফান রা., জুবায়ের ইবনে আওয়াম রা., আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা., সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা., তালহা ইবনে আবদুল্লাহ, উসমান ইবনে মাজউন, আবু উবায়দা, আবু সালামা ও খালেদ ইবনে সা’দ ইবনে আস রা. ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাদের প্রত্যেকেই হলেন ইসলাম গগনের উজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য এবং রাসুলুল্লাহ সা.-এর দীর্ঘ সংস্রব লাভকারী।
তিনি নিজ ঘরের আঙিনায় ছোট্ট একটি মসজিদ বানিয়ে নেন। সেখানে তিনি ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী। কুরআন তেলাওয়াত কালে তার চোখ থেকে অশ্রুধারা বইত। মানুষ তার কান্না দেখে জড়ো হতো এবং এ দৃশ্য তাদের মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলত।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মক্কী-জীবন:
মক্কার কাফেরদের শত নির্যাতন ও বাঁধার পরও নবীজি সা. মক্কায় ১৩ বছর ইসলামের দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। সে সময়ে আবু বকর রা. অর্থ-সম্পদ, চিন্তা-পরামর্শ, সবদিক দিয়ে রাসুল সা. কে সাহায্য করেন। তিনি ছিলেন নবীজির দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দ-বেদনার ছায়াসঙ্গী।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিদিন তার ঘরে যেতেন এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একান্তে আলাপ-আলোচনা করতেন। ইসলাম প্রচারে তার ছিল বিশেষ ভূমিকা। রাসুল সা. যখনই আরবের বিভিন্ন গোত্র বা জনসমাগমস্থলে ইসলামের দাওয়াতি কাজে যেতেন, আবু বকর রা. কে সঙ্গে নিয়ে যেতেন।
প্রাথমিক যুগে মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ছিল গোলাম শ্রেণীর। তারা মক্কার অমুসলিম মনিবের হাতে নির্যাতনের শিকার ছিলেন। আবু বকর রা. তাদেরকে তাদের মনিবদের থেকে ক্রয় করে স্বাধীন করে দিতেন। এভাবে তিনি অসংখ্য অসহায় নির্যাতিত মুসলমানকে কাফেরদের সীমাহীন শাস্তি থেকে মুক্তি দেন। হযরত বেলাল রা., আমের ইবনে ফুহায়রা রা., জুনাইরাহ রা., নাহদিয়া রা., জারিয়া বিন মুমেল রা. এবং নাহদিয়া রা. সিদ্দিকি বদান্যতার ফলেই মুক্তি লাভ করেন।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহাবীদের জীবনী জানতে প্রায় শতাধিক সাহাবী রা.-এর জীবনী সম্বলিত সাহাবী বিভাগে ভিজিট করুন।
কাফেররা যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে জুলুম- নির্যাতনের হাত বাড়াত, তখনই এই নিষ্ঠাবান রাসুল প্রেমিক নিজের জীবন শঙ্কায় ফেলে হলেও তাদের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যেতেন।
গাজওয়ায় অংশগ্রহণ:
মদিনার জীবনে মুসলমানদের অসহায়ত্বের অবসান ঘটে। কিন্তু কুরাইশরা গোপনে মুসলিম নিধনের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। তাই তারা মক্কা বিজয় পর্যন্ত রক্তাক্ত যুদ্ধের এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সকল যুদ্ধেই আবু বকর রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন পরামর্শদাতা ও সঙ্গী হিসেবে সাথে থাকতেন।
বদর যুদ্ধ:
বদর ছিল হক ও বাতিলের মধ্যে সংঘটিত প্রথম ও ইতিহাস নির্ধারণী যুদ্ধক্ষেত্র। বদর যুদ্ধে তিনি তরবারি হাতে নিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। বদর যুদ্ধে কাফের-মুশরিকরা চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছিল; তখন তিনি অসীম বীরত্বের সঙ্গে মোকাবেলা করেন। বদর যুদ্ধে নবীজি সা. সিজদায় লুটিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করছিলেন। হতাশা ও পেরেশানির কঠিন মুহূর্তে নবীজির পাশে ছিলেন।
উহুদ যুদ্ধ:
বদর প্রান্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধের তাড়নায় কুরাইশরা পুনরায় যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা মদিনা অভিমুখে রওনা হয়। উহুদ প্রান্তরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
উহুদ যুদ্ধে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মারাত্মক আহত হয়ে পড়েন। সাহাবীগণ তাঁকে পাহাড়ে নিয়ে যান। আবু বকর রা. তখন সঙ্গেই ছিলেন।
আবু সুফিয়ান পাহাড়ের নিকটে এসে চিৎকার করে বলে: মুহাম্মাদ (সা.) কি জীবিত আছে? কোনো উত্তর না পেয়ে পর্যায়ক্রমে আবু বকর রা. ও উমর রা.-এর নাম নেয়। এতেই অনুমিত হয়, কাফেররাও আবু বকর রা.-কে নবীজির পর মুসলিম উম্মাহর প্রধান ব্যক্তি মনে করত।
যুদ্ধ শেষে কাফেররা ফিরে গেলে তাদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য একদল মুজাহিদ পাঠানো হয়। আবু বকর সিদ্দিক রা.ও তাতে শামিল ছিলেন। খন্দক যুদ্ধসহ আরও যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, আবু বকর রা. সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করেন।
বনু মুস্তালিক যুদ্ধ এবং ইফকের ঘটনা:
ষষ্ঠ হিজরিতে বনু মুস্তালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সিদ্দিকে আকবার এ যুদ্ধেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। সাহাবাগণ যুদ্ধ থেকে বিজয়ী বেশে ফিরে আসেন।
পথিমধ্যে রাত হয়ে গেলে মদিনার নিকটবর্তী স্থানে মুজাহিদ বাহিনী শিবির স্থাপন করেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা রা. ছিলেন রাসুলের সহযাত্রী। সকাল হলে তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হন। ফিরে এসে লক্ষ্য করেন, তার গলার হার কোথায় যেন পড়ে গেছে। খোঁজাখুজির পর তিনি আগের জায়গায় ফিরে এলেন। কিন্তু এসে দেখেন, মুজাহিদগণ রওনা হয়ে গেছে। তিনি নিরুপায় হয়ে সেখানে বসে যান।
হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. পেছনে ছিলেন। তার দায়িত্ব ছিল: মুজাহিদ বাহিনী চলার পথে কোনো আসবাবপত্র ফেলে আসলে তা সঙ্গে নেওয়া। তিনি আয়েশা রা.-কে বসে থাকতে দেখে বিস্মিত হন এবং তাঁকে উটে চড়িয়ে কাফেলা পর্যন্ত নিয়ে আসেন। এদিকে মুনাফিকরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তারা নতুন এক ফেতনা তৈরি করে। এ ঘটনাকে অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে রটিয়ে দেয়। ফলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
এটি ছিল সিদ্দিকে আকবার রা. ও তার পরিবারের জন্য কঠিন পরীক্ষা। তবে আল্লাহ তায়ালা দ্রুত এই অপবাদ থেকে মুক্তি দেন। আয়াত নাজিল হয়,
إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِّنكُمْ ۚ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۚ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُم مَّا اكْتَسَبَ مِنَ الْإِثْمِ ۚ وَالَّذِي تَوَلَّىٰ كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ
‘নিশ্চয়ই যারা অপবাদ আরোপ করেছে তারা তোমাদেরই কিছু লোক। তোমরা এটা খারাপ মনে কোরো না; বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যারা এতে অংশগ্রহণ করেছে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবে। তাদের যে ব্যক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে তার জন্যে রয়েছে মহা শাস্তি।’
আয়াত নাজিল হওয়ার পর আবু বকর রা. মিসতাহ ইবনে উসাসার ভরণপোষণ থেকে হাত গুটিয়ে নেন। তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! যে ব্যক্তি এই ফেতনায় ভূমিকা পালন করেছে আমি তার ভরণপোষণ বহন করতে পারি না।
তখন আল্লাহ তায়ালা আয়াত অবতীর্ণ করে বলেন,
وَلَا يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنكُمْ وَالسَّعَةِ أَن يُؤْتُوا أُولِي الْقُرْبَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا ۗ أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
“তোমাদের অনুগ্রহশীল ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা যাতে নিকটাত্মীয় মিসকিন এবং আল্লাহর রাস্তায় মুহাজিরদের না দেওয়ার ব্যাপারে শপথ না করে। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ক্ষমা করে দিন? আর আল্লাহ তায়ালা তো ক্ষমাশীল। ‘
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আবু বকর সিদ্দিক রা. বলেন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই কামনা করি আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন। এরপর তিনি সর্বদা তার ভরণপোষণের শপথ করেন।
হজের নেতৃত্ব প্রদান:
হিজরি নবম বর্ষে নবীজি সা. আবু বকর রা.-কে হজের আমির বানিয়ে পাঠান এবং বলে দেন, তিনি যেন মিনার ঘোষণা দেন—আগামী বছর যেন কোনো মুশরিক হজ করতে না আসে। কোনো উলঙ্গ ব্যক্তি যাতে কাবা শরিফ তাওয়াফ না করে। এই সময়ে সুরা তওবা অবতীর্ণ হয়। সুরাটি মানুষকে শোনানোর জন্য আলি রা.-কে পাঠানো হয়।
আবু বকর রা.-এর খেলাফত:
দশম হিজরিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের জন্য মক্কা গমন করেন। এ সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দীর্ঘ খুতবা দেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এক ব্যক্তিকে ইহকাল ও পরকালের মধ্যে একটি গ্রহণের অধিকার দিলে সে ইহকালের উপর পরকালকে প্রাধান্য দিয়েছে।’
আবু বকর রা. কথাটি শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। লোকজন বিস্মিত হয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। আবু বকর সিদ্দিক রা. বুঝতে পেরেছিলেন, লোকটি দ্বারা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই উদ্দেশ্য।
এ খুতবা প্রদানের পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে যান । অসুস্থতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি মসজিদে নববিতে আসতে অপারগ হয়ে পড়েন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন আবু বকর রা.-কে নামাজের ইমামতির নির্দেশ দেন।
সিদ্দিকে আকবার রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অবগত হয়ে উমর রা.-কে বলেন, তুমি নামাজ পড়াও। উমর রা. বলেন, আপনি আমার চেয়ে ইমামতির অধিক উপযুক্ত। মোটকথা, ঐ দিন থেকে আবু বকর রা. নামাজ পড়ানো শুরু করেন ।
একদিন তিনি যথারীতি নামাজ পড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে উপস্থিত হন। আবু বকর রা. নবীজিকে দেখে পিছু ইটা শুরু করলে তিনি ইশারায় তাকে পেছাতে নিষেধ করেন। তিনি নিজে তার ডান পাশে বসে নামাজ আদায় করেন।
১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন। ঐ দিনও আবু বকর রা. নামাজ পড়াচ্ছিলেন। নবীজি তার কামরার পর্দা উঠিয়ে সাহাবিদের নামাজ আদায়ে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আনন্দে মুচকি হাসছিলেন। আবু বকর রা. মনে করেন, সম্ভবত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে আসছেন, তাই তিনি পিছু হটতে উদ্যত হন। কিন্তু নবীজি তাকে ইশারা করে নামাজ পড়াতে নির্দেশ দেন। এরপর তিনি পর্দা ফেলে দেন।
বাহ্যত মনে হচ্ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাই আবু বকর রা. নামাজের পর অনুমতি নিয়ে স্ত্রী হাবিবা বিনতে খারিজা বিনতে জুহায়েরের ঘর গমন করেন। কিন্তু তিনি ফিরে আসার আগেই নবীজির ইন্তেকাল হয়ে যায়।
এ পরিস্থিতিতে মসজিদের দরজায় তখন এক ধরনের হট্টগোল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি কাউকে কোনো কিছু না বলে সোজা আয়েশা রা.-এর ঘরে প্রবেশ করেন।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর চেহারা থেকে পর্দা উঠিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
بأبي أنت يا نبي الله لا يجمع الله عليك موتتين أما الموتة التي كتبت عليك
فقد ذقتها ثم لن تصيبك بعده موتة ابدا
“হে আল্লাহর নবী! আমার মাতাপিতা আপনার উপর কুরবান হোক। আল্লাহ আপনাকে দুটি মৃত্যু দান করবেন না। আপনার তাকদিরে যে মৃত্যু লেখা ছিল সেটা তো হয়ে গেছে, এরপর আপনি আর মৃত্যুবরণ করবেন না।”
এরপর চেহারা মোবারক চাদর দিয়ে ঢেকে কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন। এদিকে উমর রা. তখন আবেগাপ্লুত হয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি শপথ করে নবীজি ইন্তেকালের ব্যাপারটি অস্বীকার করছিলেন। আবু বকর রা. এ অবস্থা দেখে বলেন, উমর! বসে পড়ো। কিন্তু ব্যথা কাতর উমর রা. তার কথা খেয়াল করেননি। ফলে সিদ্দিক রা. আরেক জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকদের সম্বোধন করা শুরু করেন। তখন সকলেই তার দিকে ঝুঁকে পড়লে উমর রা. একাকী থেকে যান। সিদ্দিকে আকবার তখন বলেন,
أما بعد فمن كان منكم يعبد محمدا فإن محمدا قد مات ومن كان منكم يعبد الله فإن الله حي لا يموت فإن الله قال: (وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ)
‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের ইবাদত করত, সে জেনে রাখুক, মুহাম্মাদ ইন্তেকাল করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করত, সে জেনে রাখুক, আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব, তিনি কখনও মৃত্যুবরণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল, তার আগেও বহু রাসুল অতিবাহিত হয়েছেন, যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন কিংবা নিহত হন, তাহলে কি তোমরা উলটো দিকে চলবে?’
বক্তব্যটি ছিল এতই হৃদয়গ্রাহী যে, তা শুনে সকলেই প্রশান্তচিত্ত হয়ে ওঠেন। পঠিত আয়াত পরিস্থিতির অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমাদের মনে হচ্ছিল, যেন এই আয়াত ইতিপূর্বে অবতীর্ণই হয়নি।
খেলাফতের আসনে আবু বকর রা.
নবীজির ইন্তেকালের পরে মদিনায় খেলাফত নিয়ে আলোচনার উদ্ভূত হয়। আনসাররা সাকিফায়ে বনু সায়েদায় একত্রিত হয়ে খেলাফত নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। আবু বকর রা. ও উমর রা. যথাসময়ে বিষয়টি জানতে পেরে সেখানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। আবু বকর রা. উমর রা.-কে সঙ্গে নিয়ে সাকিফায়ে বনু সায়েদায় পৌঁছেন।
আনসারগণ দাবি করেন, একজন আমির হবেন আমাদের (আনসারদের) মধ্য থেকে, একজন হবেন তোমাদের (মুহাজিরদের) মধ্য থেকে। তবে, এর পরিণাম ছিল ভয়ংকর।
আবু বকর রা. নস সামনে রেখে বক্তব্য দেন এবং মুহাজিরদের মধ্য থেকে খলিফা হওয়ার যৌক্তিক দলিল উপস্থাপন করে বলেন, মুহাজিরদের মধ্য থেকেই আমির নির্বাচিত হবে, আর আনসারদের মধ্য থেকে উজির হবে। তিনি আরও বলেন: এখানে আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ ও উমর ইবনে খাত্তাব উপস্থিত আছেন । আপনারা এ দুজনের যে কারও হাতে বাইয়াত হয়ে যান ।
উমর রা. তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আবু বকর রা.-এর হাত টেনে নিয়ে বলেন, এটা হতে পারে না; আমরা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করব । আপনিই আমাদের নেতা। আল্লাহর রাসুল আপনাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।
আসলেও তখন আবু বকর রা.-এর চেয়ে মর্যাদাবান কেউ ছিলেন না। তাই উমর রা.-এর নির্বাচনকে সকলেই প্রশংসার সঙ্গে গ্রহণ করে নেন। সমাবেশের সকলেই তার হাতে বাইয়াত হয়ে যায়। এরপর সবাই নবীজির কাফন-দাফন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আবু বকর সা.-এর ঐতিহাসিক ভাষণ:
দ্বিতীয় দিন মসজিদে জনসম্মুখে বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর রা. মিম্বারে বসে আপন কর্মপন্থার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন,
أما بعد! أيها الناس فإني قد وليت عليكم ولست بخيركم، فإن أحسنت فأعينوني، وإن أسأت فقوموني، الصدق أمانة، والكذب خيانة، والضعيف فيكم قوي عندي حتى أربح عليه حقه إن شاء الله، والقوي فيكم ضعيف حتى أخذ الحق منه إن شاء الله، لا يدع قوم الجهاد في سبيل الله إلا ضربهم الله بالذل، ولا تشيع الفاحشة في قوم قط إلا عمهم الله بالبلاء، أطيعوني ما أطعت الله ورسوله، فإذا عصيت الله ورسوله فلا طاعة لي عليكم قوموا الى صلاتكم يرحمكم الله.
“হে লোক সকল! আমাকে তোমাদের শাসক নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু আমি তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। ভালো কাজ করলে তোমরা আমাকে সাহায্য করবে আর মন্দ কাজ করলে সঠিক পথে নিয়ে আসবে। সত্য হলো আমানত, আর মিথ্যা হলো খেয়ানত। ইনশাআল্লাহ। হক ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তিও আমার কাছে শক্তিশালী, আর হক আদায় না করা পর্যন্ত তোমাদের শক্তিশালী ব্যক্তিও আমার কাছে দুর্বল।
যে সম্প্রদায় আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ছেড়ে দেবে, আল্লাহ তাদের অবশ্যই লাঞ্ছিত করবেন । আর কোনো সম্প্রদায়ে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করলে অবশ্যই আল্লাহ তাদের উপর ব্যাপক বিপদাপদ চাপিয়ে দেন। আমি যতক্ষণ আল্লাহ এবং তার রাসুলের আনুগত্য করব, তোমরা ততক্ষণ আমার অনুসরণ করবে। যখন আল্লাহ এবং তার রাসুলের অবাধ্যতা করব, তখন তোমাদের জন্য আমার আনুগত্য আবশ্যক নয়। আচ্ছা, এখন নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাও, আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন।“
আলি রা.-এর বাইয়াত গ্রহণ:
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন-দাফন কাজের ব্যস্ততার কারণে হযরত আলী রা. পরামর্শ সভায় উপস্থিত হতে পারেন নি। তখন সকল সাহাবী আবু বকর রা.-এর হাতে বাইয়াত হয়ে যান। তিনিও রীতিমতো খেলাফতের দায়িত্বপালন করতে থাকেন।
তখন হযরত আলী রা. শুরুর দিকেই একবার হযরত আবু বকর রা.-এর হাতে বাইয়াত হয়ে যান। তবে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে বাইয়াত-পরবর্তী কার্যাদি পালন করতে পারেননি। হযরত আলি রা. প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতেন এবং আবু বকর রা.-এর পেছনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। ছয় মাস পর ফাতেমা রা. ইন্তেকালের পর সকল ব্যস্ততা থেকে অবসর হলে তিনি পুনরায় বাইয়াত নবায়ন করেন।
মৃত্যু: তিনি ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তিনি হযরত উমর রা. কে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। রাসুল সা.-এর কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।