হযরত আবু বকর রা. ছিলেন স্বভাবত উত্তম গুণাবলির অধিকারী। জাহেলি যুগে ক্ষমা, নম্রতা, বদান্যতা, পরোপকার, সততা ও সত্যবাদিতা তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। এ কারণেই জাহেলি যুগে রক্তপণের অর্থ তার কাছে জমা হতো। পুরো আরব জুড়ে মদপান, পাপাচার ব্যাপক থাকলেও তার চরিত্রে এসবের দাগ লাগেনি। দানশীলতা, দরিদ্র ও অসহায়দের ভরণপোষণ, নিকটাত্মীয়দের প্রতি লক্ষ্য রাখা, আতিথ্য, বিপদগ্রস্তদের সহযোগিতা সহ সব উত্তম গুণাবলি শুরু থেকেই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর এসবে আরও উৎকর্ষসাধন করে।
আবু বকর রা.-এর তাকওয়া:
তাকওয়া ছিল সিদ্দিক রা.-এর চরিত্রের সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে মন্দ ও ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি অন্তরকে ভ্রান্ত চিন্তাচেতনা থেকে মুক্ত রাখাও পরিপূর্ণ তাকওয়া। তেমনই মৌখিকভাবে অবাঞ্ছিত কথা বলাও তাকওয়ার বিপরীত। নিন্মোক্ত ঘটনা দ্বারা তাঁর তাকওয়ার উপলদ্ধি করা যায়।
ঘটনা ০১: তার এক গোলাম একবার তাকে কিছু খাবার পেশ করে। খাওয়া গ্রহণের পর গোলাম তাকে এ খাবার কীভাবে উপার্জন করেছে তা জানায়। গোলাম বলল, জাহেলি যুগে আমি এক ব্যক্তির ভাগ্য পরীক্ষা করেছিলাম। আমি আসলে ভাগ্য পরীক্ষা জানতাম না। শুধু শুধু তাকে ধোঁকা দিয়েছিলাম । আজ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সে এর বিনিময় হিসেবে এই খাবার দিয়েছে। এ বৃত্তান্ত শুনে আবু বকর রা. মুখে আঙুল ঢুকিয়ে সকল খাবার বমি করে ফেলেন। তিনি বলতেন, যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠবে জাহান্নামই তার সর্বোত্তম ঠিকানা ।
ঘটনা ০২: ঈদের দিন আয়েশা সিদ্দিকা রা.-এর ঘরে দুই আনসার বালিকা যুদ্ধের কাব্য আবৃত্তি করছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মুখ ফিরিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় আবু বকর রা. সেখানে এসে পৌঁছান। তিনি এ কাজটি পছন্দ করলেন না। তিনি আয়েশা রা.-কে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে শয়তানের এই বাজনা! তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আবু বকর! গাইতে দাও। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ঈদ রয়েছে, আর আজ আমাদের ঈদ।
আবু বকর রা. এত উঁচু মাপের খোদাভীরু ছিলেন যে, সর্বদা অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকতেন। কখনও রাগের মুহূর্তে মুখ দিয়ে কোনো কঠোর কথা বেরিয়ে পড়লে অত্যন্ত লজ্জিত হতেন। এর ক্ষতিপূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্থির হতেন না।
ঘটনা ০৩: একবার উমর রা.-এর সঙ্গে কোন এক বিষয়ে তাঁর বিবাদ লেগে যায়। কথা বলতে গিয়ে মুখ থেকে একটি কঠিন বাক্য বেরিয়ে পড়ে। পরে তিনি লজ্জিত হয়ে পীড়াপীড়ি করে উমরের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু উমর রা. ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি জানান । আবু বকর রা. তখন বিচলিত হয়ে সোজা নবীজির দরবারে উপস্থিত হয়ে সবকিছু খুলে বলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তিনবার সুসংবাদ দেন, “আবু বকর! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন। আবু বকর! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন। আবু বকর! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন।”
এদিকে উমর রা.-ও ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে অনুতপ্ত হয়ে আবু বকর রা.-কে খুঁজতে শুরু করেন। বাড়িতে না পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসেন । উমর রা.-কে দেখেই নবীজির চেহারার রং পালটে যায়। আবু বকর রা. এই অবস্থা দেখে দোজানুর উপর বসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরজ করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর শপথ! আমি জালেম ছিলাম, আমিই বাড়াবাড়ি করেছি। এভাবে বলতে থাকলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাগ থেমে আসে; তথাপি তিনি বলেন, আমাকে নবী হিসেবে পাঠানো হলে তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলে, কিন্তু আবু বকর ঠিকই আমাকে সত্যায়ন করেছিল। জানমাল দিয়ে আমার দুঃখ লাঘব করেছিল। তোমরা কি আমার কারণে আমার বন্ধুকে ক্ষমা করতে পারো না?
জুহদ তথা দুনিয়া বিমুখতা:
দুনিয়ার ধনসম্পদ ও ক্ষমতা প্রীতিকে আবু বকর রা. প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। উম্মাহকে বিভক্তির বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই তিনি রাসুল সা.-এর ওলাফের পর খেলাফতের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। নতুবা তিনি কখনও দায়িত্বের আকাঙ্ক্ষী ছিলেন না। তিনি বিভিন্ন সময় নিজ বক্তব্যে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, কেউ যদি এই বোঝা বহন (খেলাফতের দ্বায়িত্ব) করতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে তাকে এ দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেব।
রাফে আত-তাঈ বলেন, একবার আমি সিদ্দিক রা.-কে বলি, আপনি বয়স্ক মানুষ, আমাকে কিছু ওসিয়ত করুন। তিনি বলেন, আল্লাহ তোমার উপর অনুগ্রহ ও বরকত নাজিল করুন। তুমি নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, জাকাত প্রদান করবে, হজ আদায় করবে। আর সবচেয়ে বড় নসিহত হলো, কখনও রাষ্ট্রক্ষমতা বা নেতৃত্ব গ্রহণ করবে না। একজন আমিরকে দুনিয়াতে বহু জিম্মাদারি পালন করতে হয়। উপরন্তু কেয়ামতের দিনও তার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর হয়। তার আমলের ফিরিস্তিও অনেক দীর্ঘ হয়।
আবু বকর রা. তার সব সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান দেন। রাষ্ট্রীয় দ্বায়িত্ব পালনকালে মুসলমানদের একটি দানা পর্যন্ত ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় কিংবা সন্তান-সন্ততির জন্য রেখে যাওয়াটা পছন্দ করেননি।
মৃত্যুর সময় তার প্রথম ওসিয়ত ছিল— তোমরা আমার অমুক বাগান বিক্রি করে বাইতুল মালের ঋণ পরিশোধ করবে। আর আমার সম্পদের মধ্যে যা প্রয়োজন অতিরিক্ত হবে, সেটা উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর কাছে (পরবর্বতী খলিফার কাছে) পাঠিয়ে দেবে।
আয়েশা রা. বলেন: ‘ইন্তেকালের পর খোঁজখবর নেওয়া হলে একটিমাত্র গোলাম, একটি দাসী এবং দুটি উট পাওয়া যায়। এ জিনিসগুলো তখনই উমর রা.-এর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো দেখে ফারুকে আজম রা.- এর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন: “আবু বকর! আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন। তুমি আমৃত্যু দুনিয়াবিমুখতার আঁচল ছাড়োনি। আর কাউকে কোনো কিছু বলার সুযোগ দাওনি।”
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর বিনয়:
আবু বকর রা. অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। কোনো কাজ করতে কোনো প্রকার লজ্জাবোধ করতেন না। তিনি নিজেই ভেড়া-বকরি চরাতেন।
বর্ণিত আছে: তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর মহল্লার এক মেয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে আফসোস করে বলে, এখন কে আমাদের বকরিগুলো দোহন করে দেবে? আবু বকর রা. এ কথা শুনে বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি তার বকরিগুলো দোহন করে দেব। আশা করি খেলাফতের দায়িত্ব আমাকে মানুষের খেদমত থেকে বিরত রাখবে না ।
আবু বকর রা. কাপড়ের ব্যবসা করতেন। খলিফা হওয়ার পর কাঁধে কাপড়ের খান নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হন। রাস্তায় ফারুকে আজম রা. ও আবু উবায়দা রা.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তারা বলেন: ‘আল্লাহর রাসুলের খলিফা! কোথায় যাচ্ছেন? আবু বকর রা. বলেন: বাজারে। তারা বলেন: এখন আপনি মুসলমানদের একজন খলিফা। চলুন আমরা আপনার জন্য কিছু ভাতা নির্ধারণ করে দিই।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহাবীদের জীবনী জানতে প্রায় শতাধিক সাহাবী রা.-এর জীবনী সম্বলিত সাহাবী বিভাগে ভিজিট করুন।
খেলাফতের পক্ষ থেকে অভিযান প্রেরণ করা হলে আবু বকর রা. বার্ধক্য সত্ত্বেও বহুদূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে মুজাহিদদের সঙ্গে যেতেন। কোনো সেনাপতি তার সম্মানার্থে ঘোড়া থেকে নেমে যেতে চাইলে তাকে বাধা প্রদান করে বলতেন, আল্লাহর রাস্তায় সামান্য সময়ের জন্য কদম ধূলিমলিন করতে সমস্যার কিছু নেই। রাসুল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির কদম আল্লাহর রাস্তায় ধূলিমলিন হয়, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।’
অহংকার, অহমিকা থেকে সর্বদা র্রে থাকতেন। একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি অহংকারবশত আপন কাপড় ঝুলিয়ে নেয়, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।’ সিদ্দিক রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মাঝে মাঝে আমার কাপড় ঝুলে পড়ে। নবীজি বলেন, তুমি তো অহংকারীদের মধ্য থেকে নও।
আল্লাহর রাস্তায় দান:
মক্কা বিজয়ের পূর্বে যারা নিজেদের জানমাল দিয়ে প্রিয় নবীকে সাহায্য করেছেন, কুরআনে তাদেরকে বিশেষ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে,
لَا يَسْتَوِى مِنْكُمْ مَّنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِيْنَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَ قَتَلُوا
‘তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের আগে আল্লাহর রাস্তায় দান- সদকা করেছে এবং জিহাদ করেছে, তারা অন্য সকল মুসলমানদের মতো নয়। তারা মক্কা বিজয়ের পর দান-সদকাকারী ও জিহাদকারী মুসলমানদের চেয়ে উঁচু মর্যাদার অধিকারী।’
ইসলাম গ্রহণের সময় সিদ্দিক রা.-এর কাছে নগদ ৪০ হাজার দিরহাম ছিল। তিনি এসব আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহুবার তার এ দানের কথা স্বরণ করেছেন। তিনি একবার বলেছেন,
وما نفعني مال أحد قط ما نفعني مال أبي بكر
‘আবু বকরের ধনসম্পদ আমাকে যে পরিমাণ উপকৃত করেছে, অন্য কারও সম্পদ আমাকে তেমন উপকার করেনি। ‘ – জামে তিরমিজী
পোশাক ও খাদ্য:
আবু বকর রা.-এর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। তিনি মোটা কাপড় পরিধান করতেন। দস্তরখানায় কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পরও সরল জীবনযাপন আরও বেড়ে যায়।
ইন্তেকালের সময় আয়েশা রা.-কে বলেন: “যখন থেকে খেলাফতের দায়িত্ব চেপেছে, তখন থেকে আমি সাধারণ থেকে সাধারণ খাবার ও মোটা কাপড় পরিধান করা শুরু করি। মুসলমানদের ধনসম্পদ থেকে আমার কাছে একটি গোলাম, একটি উট এবং পুরোনো চাদর ছাড়া কিছুই নেই। আমার পর এগুলো উমর ইবনে খাত্তাবের কাছে দিয়ে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যেয়ো।”
জীবিকা নির্বাহ:
ব্যবসা ছিল আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম। তিনি বলেন, আমি কুরাইশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলাম। আমার ছিল অঢেল সম্পদ। ইসলামি যুগেও তিনি এ ব্যবসা করতে থাকেন। ব্যবসায়িক মাল-সামানা নিয়ে দূরদূরান্তের শহর বন্দরে সফর করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের এক বছর পূর্বে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তিনি বুসরা (শামে অবস্থিত) গিয়েছিলেন ।
খেলাফতের দায়িত্ব কাঁধে অর্পিত হওয়ার পর কুদরতিভাবে মুসলমানদের কল্যাণ এবং তাদের উপকারিতার জন্যই দিনরাত অতিবাহিত হতে থাকে। সাহাবিগণ পরামর্শ করে দৈনিক অর্ধেক বকরির মাংস এবং তার পরিবার- পরিজনদের কাপড় ও খাবার নির্ধারণ করে দেন।
আবু বকর রা. তাদের এই প্রস্তাবনা মেনে নিয়ে বলেন, ‘আমার সম্প্রদায় জানে, আমার উপার্জন পরিবারের ভরণপোষণে অক্ষম ছিল না । এখন যেহেতু আমি মুসলমানদের কাজে ব্যস্ত, তাই আবু বকরের পরিবার প্রয়োজন অনুযায়ী মুসলমানদের সম্পদ ভোগ করবে এবং তাদের কাজ করবে।’
ইবনে সাআদ এভাবে ভাতার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন যে, “আবু বকর রা. বাইতুল মাল থেকে দুটি চাদর পেতেন। এগুলো পুরোনো হয়ে গেলে তা ফেরত দিয়ে অন্য চাদর নিয়ে আসতেন। সফরের জন্য বাহন এবং খেলাফতের পূর্বে সংসারের পেছনে যতটুকু বায় হতো, খেলাফতের পর বাইতুল মাল থেকে সে পরিমাণই গ্রহণ করতেন।”